
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৯ এএম

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
রাজধানীর বনানীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় এক নারী পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন নিহতের সহকর্মীরা। সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ করে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন কয়েক হাজার শ্রমিক। নিহত শ্রমিকের লাশ নিয়ে কফিন মিছিলও করেন তারা। সকাল থেকে দুপুর প্রায় ২টা পর্যন্ত ৭ ঘণ্টা সড়কের দুই পাশ অবরোধ করে রাখেন তারা। এমনকি উত্তরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচলও বন্ধ করেন তারা। পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধের কারণে রাজধানীর বনানী ও মহাখালী থেকে যানজট ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সব সড়কে। এতে স্থবির হয়ে পড়ে তেজগাঁও, মগবাজার, বাংলামোটর ও গুলশান, নতুনবাজার, রামপুরা, হাতিরঝিল, ইসিবি চত্বর, মাটিকাটা, শ্যাওড়া, খিলক্ষেত, উত্তরা, বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। এতে সকালে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অফিস ও কর্মস্থলমুখী মানুষ পড়েন নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাজধানীতে এমন যানজটের কবলে পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে-এমন ভাবনাও ছিল না তাদের কারও। একই স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গাড়ি রেখে অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছান। শ্রমিকদের সড়ক ছেড়ে দিতে পুলিশ বারবার অনুরোধ করলেও তা মানেনি বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। একপর্যায়ে ঘাতক চালককে গ্রেফতার, দুর্ঘটনার স্থানে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ এবং নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের আশ্বাসে ৪৮ ঘণ্টা আলটিমেটাম দিয়ে দুপুর দেড়টার পর সড়ক ছাড়েন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, সড়কে এমন অরাজকতা আর কতদিন চলবে, তা যেন ভাগ্যের লেখন হয়ে গেছে।
পুলিশ শ্রমিকদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিতে দুপুর পর্যন্ত কেন সময় নিল, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। যান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার স্পট ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সকাল থেকে রাস্তা অবরোধ করলেও আমরা বিভিন্ন ডাইভারশনের মাধ্যমে মানুষের কমফোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে কথা বলেছি, পুলিশ কমিশনার স্যার কথা বলেছেন, তারা অনুরোধ রেখেছেন, আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। জিয়া কলোনি, জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতে দিয়েছে। আমরা ফোর্স মোতায়েন করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি সচল রাখার ব্যবস্থা করেছি।
ডিএমপির বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল সারোয়ার যুগান্তরকে জানান, সকাল থেকে অবরোধ করে রাখার পর দুপুর দেড়টার দিকে সড়ক ছেড়ে দেন শ্রমিকরা। ঘাতক চালককে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকনেতারা আশ্বস্ত করেছেন যে, নিহতের পরিবার ন্যায়বিচার পাবেন। এছাড়া আমরা নিশ্চিত করেছি দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় সড়কের মহাখালীগামী লেনে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান পোশাক শ্রমিক মিনারা আক্তার (১৮)। গুরুতর আহত হন দুই নারী পোশাক শ্রমিক। তারা মাসুদ অ্যাপারেলসের কর্মী। আহত পোশাক শ্রমিক সুমাইয়া আক্তারকে দ্রুত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পরই সড়ক বন্ধ করে আন্দোলনে নামে তার সহকর্মীরা। এ ঘটনায় ট্রাকটি জব্দ করেছে পুলিশ। তবে চালক পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়েছে পুলিশ।
সড়কে নিহত মিনারা থাকতেন করাইল বস্তিতে। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা থানায়। তার বাবা ইন্নস আলী ও মা আনোয়ারা। বনানী থানার এসআই মো. ইউসুফ যুগান্তরকে জানান, স্পট ডেট হওয়ায় হাসপাতালে লাশ নেয়নি নিহতের সহকর্মিরা। ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রামের বাড়ি নিয়ে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, দুর্ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, এর পাশেই সড়কের ইউলুপ। প্রশস্ত রাস্তাটি ইউলুপের কাছে এসে সংকুচিত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফুটওভারব্রিজ। শ্রমিকরা জানান, ফুটওভারব্রিজ দূরে হওয়ায় তারা নিয়মিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই স্থান দিয়ে সড়ক পার হয়ে অফিসে যান।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী শ্রমিক জানান, তিনজন একসঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। দ্রুতগামী বলাকা বাস প্রথমে তাদের ধাক্কা দেয়। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পরে একটি পিকআপভ্যান দুজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত মিনারার মাথা থ্যাঁতলে মগজ বের হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। দুর্ঘটনার সিসি টিভির ফুটেজও দেখা গেছে চার থেকে পাঁচজন নারী একসঙ্গে সড়ক পার হচ্ছিলেন। এ সময় একটি ট্রাক স্বাভাবিক গতিতেই তাদের চাপা দেয়।
সড়কে যানজটে কী ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন, তা জানান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাশিতা মালিক প্রিয়ন্তি। তিনি বলেন, সকালে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে তেজগাঁও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে আমাদের গাড়িটি ওঠার পরই জানতে পারি সামনে কোনো ঝামেলা হচ্ছে। কোনো গাড়ি সামনে যেতে দিচ্ছে না। একপর্যায়ে গাড়ি রেখে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে আবার নিচের রাস্তায় নেমে সিএনজি অটোরিকশা করে অনেক পথ ঘুরে ইউনিভার্সিটি পৌঁছাই। হাসান নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বলেন, মহাখালী যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি জায়গা থেকে নড়ছে না। পেছনে ফিরে যাব, সে সুযোগও নেই। বাধ্য হয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখি কোন পর্যন্ত গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারি। তিনি বলেন, সড়কে আমাদের নিত্য ভোগান্তি কবে বন্ধ হবে। এই দাবি, সেই দাবি-নানা দাবিতে সড়ক বিপর্যস্ত। আমরাও সড়কে নিরাপত্তা চাই।
এদিকে সড়কে পোশাক শ্রমিককে চাপা দেওয়া গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন সাময়িক স্থগিত করেছে পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। পত্রে বলা হয়, ঢাকা মেট্রো-ন-১৪-০৭৬২ নম্বর মোটরযানটি ১০ মার্চ ঢাকার বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহণ বিধিমালা ২০২২-এর বিধি ৪৬ অনুযায়ী ঢাকা মেট্রো-ন-১৪-০৭৬২ নম্বর মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো। পত্র অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রো-ন-১৪-০৭৬২ নম্বরের ট্রাকটির মালিক দুইজন-টিটন ইসলাম ও রহিদুল ইসলাম। তাদের দুজনের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায়।