নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের বিক্ষোভ পণ্ড
পুলিশের ধাওয়া পালটাধাওয়ায় পল্টন রণক্ষেত্র

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর পল্টন এলাকায় পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে শুক্রবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরির। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ওই এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল। টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এই ঘটনায় আটক করা হয় অন্তত ২২ জনকে। আহত হন দুই গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্তত ৫ জন। এছাড়া গোপন বৈঠক করার সময় উত্তরায় গ্রেফতার হিজবুত তাহরিরের তিন কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার জুমার পর বায়তুল মোকাররম থেকে ‘মার্চ ফর খিলাফা’ নামে একটি বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেয় নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরির। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই বিক্ষোভ সফলের লক্ষ্যে পোস্টারও লাগায়। নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের এই বিক্ষোভের বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজরদারি ছিল গোয়েন্দাদের।
নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের কর্মসূচিকে ঘিরে এদিন দুপুর থেকেই বায়তুল মোকাররম মসজিদকে ঘিরে পল্টন ও আশপাশ এলাকায় কঠোর নজরদারি ছিল সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের। জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিলটি বের করেন হিজবুত তাহরিরের সদস্যরা। তারা স্লোগান দিতে থাকেন-‘মুক্তির এক পথ-খিলাফত-খিলাফত।’ এ সময় সবার হাতে সাদা ও কালো এবং লাল কাপড়ে কালেমা খচিত পতাকা দেখা যায়। পুলিশ প্রথম বাধা দিলে তারা বাধা ডিঙিয়ে পল্টনের দিকে মিছিল নিয়ে আসেন। পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগরের দিকে যাওয়ার সময় আবার বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া ঘটে। পরে তারা মিছিল নিয়ে বিজয়নগরের দিকে এগোতে থাকেন। বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে থেকে ঘুরে আবার মিছিলটি পল্টনের দিকে আসে। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে শুরু হয় ধাওয়া-পালটাধাওয়া। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পল্টন মোড় ও আশপাশের এলাকা। এ সময় পল্টন এলাকায় চলাচলকারী মানুষ আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তবে মাঠে র্যাব থাকলেও তাদের তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একের পর এক টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে দেখা যায় পুলিশকে। এতে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন গলিতে ঢুকে যান। এ সময় অন্তত ১৮ জনকে আটক করে পুলিশ। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে আটক করা হয় আরও ৪ জনকে। এর প্রায় ১ ঘণ্টা পর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পল্টন এলাকার সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদ আলম বলেন, আইন অমান্য করে হিজবুত তাহরিরের সদস্যরা মিছিলের চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের বিষয়ে সতর্কাবস্থায় আছে পুলিশ। পুলিশের রমনা বিভাগের আরেক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জুমার নামাজে অনেক মুসল্লি থাকায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে হিজবুত তাহরিরের মিছিলে বাধা দেওয়া হয়নি। তাদের হালকা বাধা দিয়ে পল্টন ও বিজয়নগরের দিকে নিয়ে আসা হয়। এরপর এই এলাকাতেই তাদের প্রতিরোধ করা হয়। তিনি জানান, হিজবুত তাহরিরকে ছত্রভঙ্গ করতে বেশ কয়েক রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়া হয়েছে।
আটক : পল্টনে পুলিশের সঙ্গে হিজবুত তাহরিরের কর্মীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন অলিগলি থেকে একে একে ১৮ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন-আবু শোয়াইব, মাশফিউর রহমান আশফাক। আটক অন্যদের নাম জানা যায়নি। তাদের প্রিজন ভ্যানে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে হিজবুত তাহরিরের ৪ কর্মীকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। তারা হলেন, রাফসান আহমেদ সাজ্জাদ (২২), রেদওয়ান হাসান (২১), হাবিবুর রহমান (২৪), আব্দুল্লাহ (২০)। শাহবাগ থানার এসআই একরামুল হক শুক্রবার বিকালে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। গ্রেফতারদের দাবি, ধাওয়া-পালটাধাওয়ার সময় রাফসান আহমেদ সাজ্জাদ কিছুটা আহত হন। তাকে চিকিৎসার জন্য তারা ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটকের সংখ্যা জানানো হয়নি।
কড়া নিরাপত্তা : জুমার নামাজের আগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সরেজমিন দেখা গেছে, নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচিকে ঘিরে বায়তুল মোকাররমের সামনে ও আশপাশের এলাকায় সতর্ক অবস্থান নেন সেনাবাহিনী, র্যাব, এপিবিএন, সিটিটিসিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা। বায়তুল মোকাররম ও আশপাশ এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি চালান তারা। নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের তল্লাশি করে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। পল্টন মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যদের মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। পল্টন মোড় থেকে গুলিস্তানমুখী সচিবালয়ের বিপরীত পাশের সড়কে একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি), একটি জলকামান ও একটি প্রিজন ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বায়তুল মোকাররম থেকে পল্টন মোড়মুখী সড়কে পুলিশের আরেকটি প্রিজন ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
৩ জন রিমান্ডে : বায়তুল মোকাররম থেকে ‘মার্চ ফর খিলাফা’ বিক্ষোভ সফলের লক্ষ্যে গোপন বৈঠক করার সময় বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেফতার তিনজনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। তাদের একজনকে ২ দিন এবং দুজনকে ১ দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মোহাম্মদ জোনাইদের আদালত শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। শুক্রবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর প্রেরিত এক বার্তায় জানানো হয়, হিজবুত তাহরির একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন। আইন অনুযায়ী এদের সব কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর আগে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, হিজবুত তাহরির বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন। জননিরাপত্তার প্রতি হুমকি বিবেচনায় ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ অনুযায়ী নিষিদ্ধ ঘোষিত যে কোনো সংগঠনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, পোস্টার-লিফলেট বিতরণ ও অন্যান্য উপায়ে প্রচারণাসহ সব কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হিজবুত তাহরিরসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠন সভা, সমাবেশ ও যে কোনো উপায়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলে ডিএমপি প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর থেকে গোপনে কার্যক্রম চালালেও প্রকাশ্যে আসেনি সংগঠনটি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সংসদ ভবনের সামনে মিছিল বের করে নিজেদের প্রকাশ্য অস্তিত্ব জানান দেয় হিজবুত তাহরির। এরপর ঢাকায় অন্তত তিনটি বড় আকারে মিছিল করে সংগঠনটি। এমনকি এসব মিছিলে ঢাকার অনেক নামিদামি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয়। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, নিষিদ্ধ থাকার পরও হিজবুত তাহরির গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। আগে তাদের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তাদের নজর কিশোর-তরুণদের প্রতি।
হিজবুত তাহরীর আ.লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে-গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ : হিজবুত তাহরীর আবারও আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে তাদের ফিরিয়ে আনতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতারা। এ সময় তারা হিজবুত তাহরীরের মিছিলে অংশ নেওয়া সবাইকে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের দাবি জানান। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের মার্চ ফর খিলাফত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনটির নেতারা এমন মন্তব্য করেন। এ সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব জাহিদ আহসান, ঢাবি আহ্বায়ক আব্দুল কাদের, কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসসি চৌধুরী, ঢাবি মুখ্য সংগঠক হাসিবুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় মুখপাত্র আশরেফা খাতুন ও ঢাবি মুখপাত্র রাফিয়া রেহনুমা হৃদিসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী বলেন, আমরা সহস্র শহিদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছি জঙ্গিবাদের আস্তানা বানাতে নয়। আজকে পুলিশ মিছিল করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা মনে করি এটি বাংলাদেশকে নিয়ে চলা ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। শাহবাগেও আমরা দেখলাম ইভটিজারদের পক্ষে থাকা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ এবং সেনাবাহিনী। এর জবাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে।