Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জুলাই আন্দোলনে আহতদের রোজা

তৃপ্তি মেটে না হাসপাতালের সেহরি-ইফতারে

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তৃপ্তি মেটে না হাসপাতালের সেহরি-ইফতারে

বুধবার দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় সময় ২টা। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-নিটোর তথা পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় তলার ‘বি’ ওয়ার্ডের একটি শয্যায় চুপচাপ শুয়েছিলেন সাদ আব্দুল্লাহ (১৯)। জুলাই আন্দোলনে বাম পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগার পর ৭ আগস্ট থেকে ঠাঁই হয়েছে এখানে। ঢোলের মতো ফুলে থাকা পায়ের যন্ত্রণার সঙ্গে চোখে-মুখে রাজ্যের ক্লান্তির ছাপ। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টারত অবস্থায় বলতে থাকেন, রোজা রেখে টায়ার্ড (ক্লান্ত)। সেহরিতে কী খেয়েছেন জানতে চাইলে কিছুটা বিব্রতবোধ করেন। এ সময় পাশে থাকা ভাই আবু সাইদের অভয় পেয়ে জানান, হাসপাতালের দেওয়া সেহরি খেয়েছেন। তালিকায় ছিল এক পিস খাসির মাংস, সামান্য ঝোলসহ এক টুকরো মাছ, ডাল ও এক প্লেট ভাত। শুনে মনে হয় কত উন্নত খাবার। তবে এখানকার কারোরই মন জুড়ায় না। মেডিকেলের খাবার যেমনটা হয় এখানেও তেমন।

কুরআনের হাফেজ সাদ আব্দুল্লাহ আরও বলেন, বুদ্ধি হওয়ার পর রমজানের রোজা ভাঙিনি। প্রতিবার বাড়ির খাবার খেয়ে রোজা রাখতাম। আব্বু-আম্মুর সঙ্গে ইফতার করতাম। প্রথম সেহরিতে হাসপাতাল থেকে ডিম ভুনা দিয়ে ডাল-ভাত দিয়েছিল। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে খাই। দ্বিতীয় দিন দুই পিস গরুর মাংস, এক টুকরো মাছ, ডাল ও ভাত ছিল। হাসপাতাল থেকে ইফতার দেয় না। তবে সিদরাহ ফাউন্ডেশন ২৫০ মিলির এক বোতল পানি, দুইটা খেজুর, দুইটা পিঁয়াজু, একমুঠো ছোলা, একটি সেদ্ধ ডিম ও ছোট প্যাকেটে খিচুরি দেয়।

৪১নং শয্যার পাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন বিলকিস আক্তার। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে পায়ে বুলেটবিদ্ধ ছেলে আব্দুল্লাহ আহমদকে নিয়ে গত ৭ মাস ধরে হাসপাতালে আছি। ছেলে ও আমি রোজা রাখি। রোগীর খাবার দিলেও স্বজনদের দেয় না। আগে বাড়িতে সেহরি ও ইফতারে নিজের মতো রান্না করতাম। হাসপাতালে থাকায় ছেলের পছন্দের আইটেম খেতে দিতে পারছি না। ছেলে মোগলাই খেতে পছন্দ করে। বাসায় গিয়ে নিয়ে আসতে বলে। কিন্তু একা রেখে যাব কিভাবে। সেহরি-ইফতারের কষ্টের কথা চিন্তা করে ছোট ছেলেকে ওর মামার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। চিকিৎসাধীন আহতরা ক্যান্টিন থেকে একটু ভালো করে (স্পেশালভাবে) রান্না করে দিতে হাসপাতালের পরিচালককে বলেছে। এটা করতে পারলে রোজা রাখার কষ্ট হয়তো কিছুটা কমত।

তিনি আরও বলেন, আগে মিরপুর ডিওএইচএসে থাকতাম। ৫০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতাম। ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। শ্বশুরের চিকিৎসা ও করোনা মহামারিতে স্বামীর ব্যবসায় ধস নামে। ছেলে আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়। প্রতিদিন একই ধরনের খাবার খেয়ে ছেলে বলে আম্মু হাসপাতালের সামান্য খাবারে পেটও ভরে না, স্বাদও পাই না। বি-৪৪নং বিছানায় ভর্তি থাকতে দেখা যায় মো. ইমন কবিরকে (২২)। ডান পায়ের হাঁটুর নিচে নার্ভ ইনজুরির কারণে রক্তনালি কাটা পড়েছে। পেশিতে শক্তি পান না। পায়ের আঙুল নাড়াতে পারেন না। ৭ মাস ধরে পায়ে ইলিজারভ পরিয়ে রাখা হয়েছে। ইমনের মা স্বপ্না কবির বলেন, আগে সকালে ডিম, দুধ, কলা, দুপুরে স্বাভাবিক খাবার এবং রাতে ডিম-কলা দিত। রোজা শুরুর পর এগুলো দেয় না। ছেলে ও আমি রোজা রাখি। কিন্তু হাসপাতালের খাবারে হয় না। বাইরে থেকে খাবার কিনে খাওয়াচ্ছি। চতুর্থ তলার চার নম্বর শয্যায় শুয়েছিলেন ২১ বছর বয়সের যুবক মো. রোমান হোসেন। শয্যার মেঝেতে বসে বাবা মো. মফিদুল ইসলাম বৈদ্যুতিক (ইনডাকশন) চুলায় নুডুলস ও মুরগির মাংস রান্না করছিলেন। তিনি বলেন, রোমান মোহাম্মাদপুর টাউন হল মার্কেট এলাকায় একটি রেঁস্তোরায় কাজ করত। আন্দোলনে গিয়ে ১৯ জুলাই ডান পায়ের হাঁটুর ওপর গুলি লাগে। এখন পর্যন্ত তিনটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও দুটি করতে হবে। ছেলে গত বছর সব রোজা ছিল, এবার পারছে না। কারণ প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর চারটা অ্যান্টিবায়োটিক, ১২ ঘণ্টা অন্তর আরও একটি অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যালসিয়াম, প্যারাসিটামল ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে হয়। আমি (বাবা) রোজা রাখি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে সেহরি-ইফতার দেয় না। ছেলে বিভিন্ন খাবার খেতে চায়, সেহরি-ইফতারে আমার সঙ্গেও খাবার খায়। তাই গত সপ্তাহে ৪২০০ টাকা দিয়ে একটি ইনডাকশন চুলা কিনেছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, জুলাই বিপ্লবে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থতলায় ৪৮ জন করে বর্তমানে ৯৬ জন রোগী আছেন। আহতদের অনেকের শারীরিক ঘাটতি পূরণে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দরকার। চিকিৎসাধীন অনেকে রোজা রাখছেন। ফলে রোজার মাসে বিশেষ খাবার বরাদ্দ দেওয়া হলে ভালো হয়।

হাসপাতাল পরিচালক ডা. আবুল কেনান বলেন, আহতরা ক্যান্টিনে বসে খাবার খাওয়ার বায়না ধরেছেন। আমাকেও জানিয়েছেন। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। আহতদের মধ্যে যারা রোজা রাখছেন তাদের সেহরি দেওয়া হচ্ছে। একটি ফাউন্ডেশন ইফতার দিচ্ছে। বিশেষ বরাদ্দ পেলে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম