Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রাজধানীতে ছিনতাই, অস্ত্রবাজি, খুনোখুনি

‘চোখ বুজলেই পাই গুলির আওয়াজ’

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘চোখ বুজলেই পাই গুলির আওয়াজ’

এতগুলো গুলি খেয়েও কিভাবে বেঁচে গেলাম জানি না। বলতে পারেন ভাগ্য। নতুন করে আরেকবার জীবন ফিরে পেয়েছি। কিন্তু সেই আতঙ্ক এখনো পিছু ছাড়েনি। চোখ বুজলেই পাই গুলির আওয়াজ। এক অজানা ভয় সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করে ফেরে। এভাবেই নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন। সম্প্রতি রাজধানীর বনশ্রীতে তার ওপর সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের গুলি চালানোর ঘটনা ভাইরাল হয়। 

এ ঘটনায় ভাগ্যক্রমে আনোয়ার বেঁচে গেলেও ছিনতাই থেমে নেই। এমনকি চোখ উপড়ে অথবা হাতের কবজি কেটে ভিডিও ছাড়া হচ্ছে টিকটকে। দুর্বৃত্তদের হাতে অহরহ ঘটছে প্রাণহানি। একের পর এক এমন সব দুর্ধর্ষ অপরাধের রেকর্ড হচ্ছে রাজধানীতে। অথচ এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে একরকম নির্বিকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

সরেজমিন উত্তরা : ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা। উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে একদল স্কুল ছাত্রের জটলা। তুমুল হইচই। হাতেনাতে ধরা পড়েছে দুই ছিনতাইকারী। তাদের গণধোলাই চলছে। এমন দৃশ্য দেখতে উৎসুক জনতার ভিড় জমেছে সেখানে। আরও কিছুদূর সামনে এগোতেই ৭ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন উত্তরা হাইস্কুল। পাশের গলিতে তখন কয়েকজন তরুণ প্রকাশ্যে মাদক সেবন করছে। 

স্থানীয় এক রিকশাচালক জানান, এমন চিত্র প্রতিদিনের। সবাই দেখে। কিন্তু কেউ এসব নিয়ে কিছু বলার সাহস করে না। বিশেষ করে ৩ নম্বর সেক্টরে মাদকের আস্তানা বেশি। সেখানে সম্প্রতি মার্গারিটা নামের একটি মদের বার ঘিরে মাদক ব্যবসার আখড়া গড়ে উঠেছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী সানি ওরফে কনডম সানির নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সম্প্রতি কনডম সানি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। 

সূত্র জানায়, উত্তরা ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন সাঙ্গাম মোড় ঘিরে স্থানীয় বখাটে, কিশোর গ্যাং এবং পেশাদার সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেশি। এছাড়া ১১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডসংলগ্ন লেকপাড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। এলাকাটি নীরব হওয়ায় সেখানে প্রকাশ্যে মাদকের আড্ডা বসে। এর বাইরে ৯ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন আধুনিক মেডিকেল কলেজের পেছনের বস্তি ঘিরে রীতিমতো অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। 

স্থানীয়রা বলছেন, উত্তরা এলাকায় বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দাপট সবচেয়ে বেশি। পার্শ্ববর্তী তুরাগ, টঙ্গির পাকুরিয়া এবং আব্দুল্লাহপুর থেকে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং সদস্যরা এসে বিভিন্ন সেক্টরে ঢুকে পড়ে। তাদের কেউ কেউ গভীর রাত পর্যন্ত মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধ ঘটিয়ে শেষ রাতে এলাকা ছাড়ে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, ছোটন নামে বহিরাগত এক কিশোর গ্যাং লিডারের নেতৃত্বে উত্তরায় নিয়মিত ছিনতাই এবং মারামারির ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যার পর ছোটন ও তার দলবল টঙ্গী থেকে এলেও ভোরের আলো ফোটার আগেই সে এলাকা ছাড়ে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরা ৬ ও ৮ নম্বর সেক্টর ঘিরে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ব্যাপক। বিশেষ করে ৬ নম্বর সংলগ্ন উত্তরা পাবলিক স্কুলের পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ পিকআপ স্ট্যান্ড ঘিরে সন্ত্রাসীদের ব্যাপক আনাগোনা। এছাড়া এলাকার বিস্তীর্ণ ফুটপাতে চাঁদাবাজি করছেন পুষ্প নামের স্থানীয় এক সন্ত্রাসী। আগে তিনি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। কিন্তু আগস্টে পটপরিবর্তনের পর পুষ্প নিজেকে ছাত্রদল নেতা বলে পরিচয় দিচ্ছেন। 

মোহাম্মদপুর : ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার কল্যাণে রীতিমতো রেড জোন খ্যাতি পেয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর। বিশেষ করে নবোদয় হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, বছিলা, রায়েরবাজার এবং আসাদগেট এলাকা রীতিমতো ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় একাধিক ছিনতাই গ্রুপ ছাড়াও পেশাদার ডাকাত দল এবং কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত সবচেয়ে বেশি। 

সূত্র বলছে, নবোদয় এলাকায় স্থানীয় সন্ত্রাসী বাবু ওরফে টুন্ডা বাবু, অ্যলেক্স সুমন ও রাফাত গ্রুপের অন্তত ২০ জন ছিনতাইকারী সক্রিয়। এছাড়া ঢাকা উদ্যান এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ছিনতাইয়ে জড়িত পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নাঈম ওরফে ভাগনে নাঈম, শ্যুটার রবিন ও রক্তচোষা জনি গ্রুপ। পাশাপাশি চাঁদ উদ্যান এলাকায় সক্রিয় স্থানীয় সন্ত্রাসী দিন ইসলাম দিলা ওরফে দিলা গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়া চল্লিশ ফিট ও আশপাশের এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য ফারুক খান ওরফে অভি, ফাটা আলামিন এবং শাহিন গ্রুপের সদস্যদের তৎপরতা দেখা যায়। 

এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নবোদয় হাউজিংয়ের পরিচালক শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতি অবনতির দিকে। এ কারণে নবোদয় এলাকায় রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমনকি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে এলাকার ভাড়াটিয়াদের অনেকে বাসা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে বাসা নিচ্ছেন। তবে এমন অবস্থা অচিরেই কেটে যাবে বলে জানিয়েছেন বছিলা সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন সৈকত ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ছিনতাই। ৫ আগস্টের পর থেকেই মূলত এমন অবস্থা বিরাজ করছে। ছিনতাইকারীদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ দিনের বেলা এলাকায় অটো চালায়। কিন্তু রাতে তারা ছিনতাই বা ডাকাতি করে। আমরা এদের নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছি। শিগগিরই পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হবে। 

মিরপুর : ঘন বসতিপূর্ণ মিরপুর এলাকাও ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। বিশেষ করে শাহ আলী, পল্লবী, মিরপুর-১১ নাভানা, সিরামিক রোড, কালসী, পূরবী, সাগুফতা, বাউনিয়া বাঁধ এবং পলাশনগর এলাকার পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। এখানে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাই বা ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। 

পুলিশ বলছে, প্রায় ডজনখানেক সন্ত্রাসী এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের অনেকেই পুলিশের তালিকাভুক্ত। বিশেষ করে স্থানীয় সন্ত্রাসী শরীফ ওরফে ডাঁসা শরীফ, আশিক ওরফে নাভানা আশিক, বাংলা অনিক ওরফে ভইর‌্যা দে, রাজন, আদর্শ নগর এলাকার সুজন, ব্লেড রনি, হারুন, গুজা রিয়াজ, শহিদুল, শুভ, তুহিন বিল্লাল এবং টুটুলকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এছাড়া উত্তর কালশী এলাকার সন্ত্রাসী হাবিব, আলামিন ওরফে চোর আলামিন, চোর সুজন, রাজ, সোহেল এবং আফ্ফানসহ ২৫ সদস্যের একটি দলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

সূত্র বলছে, শাহ আলী এলাকায় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসাবে সম্প্রতি পুলিশের তালিকায় ২৪ জনের নাম উঠেছে। এদের নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সন্ত্রাসী রবিন এবং রুবেল ওরফে ডুক্কু রুবেল। এছাড়া উত্তর বিশিল এলাকায় সজিব বাহিনী, নিউ সি-ব্লক এলাকায় ইমন, নাডা সুমন এবং সিডি সোহাগের নেতৃত্বে একাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। 

স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাইকারী, কিশোর গ্যাং ছাড়াও সব ধরনের অপরাধী গ্রফতারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি আগের থেকে উন্নতির দিকে। তবে এখনো যেসব সন্ত্রাসী অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। 

রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন : মোহাম্মদপুর, উত্তরা এবং মিরপুর প্রতিনিধি


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম