ট্রাম্প-জেলেনস্কি ঝগড়া বিশ্বজুড়ে তোলপাড়

যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দিনটা ছিল শুক্রবার। হোয়াট হাউজের ওভাল অফিসে মুখোমুখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। পাশেই ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। চলছে হাই প্রোফাইল মিটিং। অন্যদিকে হোয়াইট হাউজের ওয়েস্ট উইংয়ের হেঁসেলে জেলেনস্কির আপ্যায়নে রান্নার ধুম। এরই মধ্যে শোনা গেল উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের উচ্চৈঃস্বর। ট্রাম্পের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন জেলেনস্কি। একেবারে ক্যামেরার সামনেই। উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে হোয়াইট হাউজ ছাড়তে বাধ্য হন জেলেনস্কি। স্প্রিং গ্রিন স্যালাড ও রোজমেরি রোস্টেড চিকেনের বদলে একরকম ‘ঘাড় ধাক্কা’ খেতে হলো ইউক্রেনের ‘যুদ্ধংদেহী’ প্রেসিডেন্টকে। ট্রাম্প-জেলেনস্কির এ ঝগড়া নিয়েই তোলপাড় বিশ্ব। রীতিমতো হোঁচট খেল বিশ্ব! তিন বছরেরও বেশি সময় ধরা চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের গতিবিধি বুঝতে চোখ-কান তাক করে থাকা বিশ্ব গণমাধ্যমের পর্দায় ভেসে উঠল বিশ্ব রাজনীতির আরেক নতুন ইতিহাস-ঝগড়া! ঐতিহাসিক বিতণ্ডা! শান্তির সওদা করতে এসে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি। নেতায় নেতায় ‘চুল ছেঁড়াছেঁড়ি’! এএফপি, রয়টার্স, সিএনএন ও টেলিগ্রাফ।
নজিরবিহীন এ ঘটনার পর মুহূর্তেই থমকে গেছে বিশ্ব-রাজনীতি। শুরু হয়েছে নতুন মেরুকরণ। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে একাট্টা পুরো ইউরোপ। পক্ষান্তরে কার্যত একাই হয়ে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের আক্রমণের শিকার হওয়ার পর জেলেনস্কির সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য ইউরোপীয় নেতারা একযোগে দাঁড়িয়েছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বিতর্কের পর দুজনের সঙ্গেই কথা বলেছেন এবং ইউক্রেনের প্রতি তার ‘অটল সমর্থন’ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি। আজ যুক্তরাজ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যেখানে ইউক্রেনের জন্য সমর্থন নিয়ে আলোচনা হবে। জেলেনস্কি সেখানে অংশ নেবেন বলেও আশা করা হচ্ছে। সম্মেলনে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি সমর্থন পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইউক্রেনীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তার সঙ্গেও কথা বলেছেন জেলেনস্কি। ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘এখানে আগ্রাসনকারী হলো রাশিয়া। আর হামলার শিকার হলো ইউক্রেন।’ জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয়দের চেয়ে বেশি শান্তি অন্য কেউ চায় না। আমরা শুধু স্থায়ী শান্তির ওপর কাজ করছি। ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করে বলছি, তারা জার্মানি এবং ইউরোপের ওপর নির্ভর করতে পারে।’
তবে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান কাজা কালাস। তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘এটি পরিষ্কার, মুক্ত বিশ্বের নতুন একজন নেতা প্রয়োজন।’ এছাড়া জেলেনস্কিকে ‘শক্ত’ থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। জেলেনস্কির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটো, লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট জিতানাস নওসেদাও। এছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নেতারাও জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন শক্তভাবেই। তবে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান। তিনি ট্রাম্পের পক্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘শক্তিশালী ব্যক্তি শান্তি আনে। দুর্বল ব্যক্তি যুদ্ধ বাধায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ শান্তির পক্ষে সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন। যদিও অনেকের জন্য এটি হজম করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ।’ তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের এই বিরোধ পুরো ইউরোপের জন্যই মাথাব্যথার কারণ। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ, পাশাপাশি সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্ব অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক পটপরিবর্তনের। এই দ্বন্দ্ব আদৌ শান্তি ফেরাবে কিনা তা শুধু দেখার অপেক্ষা।
উল্লেখ্য, শুক্রবার ওভাল অফিসে আলোচনাটা আন্তরিকভাবেই শুরু হয়েছিল। তবে প্রায় আধা ঘণ্টা পরেই পালটে যেতে থাকে দৃশ্যপট। বৈঠক চলতে চলতে হঠাৎই বাগ্?যুদ্ধে জড়ান ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। এছাড়া ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে আমরা একা ছিলাম এবং আমরা কৃতজ্ঞ।’ এ কথায় খেপে যান ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আপনারা একা ছিলেন না। আমরা এ স্টুপিড প্রেসিডেন্টের (সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন) মাধ্যমে আপনাদের ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার দিয়েছি।’ ইউক্রেনের নেতাকে কটাক্ষ করে ট্রাম্প বলেছেন, আমি আপনার জায়গায় থাকলে, এই পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হতো না। উত্তরে জেলেনস্কিও বলে উঠেন, তার কারণ আপনি (ট্রাম্প) ইউক্রেনকে ওদের (রাশিয়ার) হাতে তুলে দিতেন। দুই নেতার বাগযুদ্ধের মধ্যেই জেডি ভ্যান্সের কথার সূত্র ধরেও বাড়তে থাকে উত্তেজনার পারদ। ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যকার আলোচনায় একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তিক্ত বিভাজনগুলোও প্রতিফলিত হতে থাকে। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দুজনকেই জেলেনস্কিকে ভর্ৎসনা করতে দেখা যায়। বাগবিতন্ডার একপর্যায়ে হোয়াইট হাউজ ছাড়েন জেলেনস্কি। অনেকটা তাকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনাই ঘটে সেখানে। পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের মাঝে ‘অনড়’ জেলেনস্কিকে নিশানা করে ট্রাম্প বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। শান্তি চুক্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। তার জন্য কিছু ‘আপস’ও করতে হবে। তবে তা খুব বেশি নয়। তিনি আরও বলেন, ‘চুক্তিবদ্ধ না হলে যুক্তরাষ্ট্র আপনার সঙ্গে থাকবে না। আপনাকে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’