৩৩ মন্ত্রীসহ আ.লীগের দুই শতাধিক এমপি লাপাত্তা
আত্মগোপনে থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক ১৮ মন্ত্রী, ১৩ প্রতিমন্ত্রী, একজন উপমন্ত্রী, স্পিকার, চিপ হুইপ-হুইপসহ আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক সংসদ-সদস্য এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা তারাও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেউ কেউ ইতোমধ্যে সুযোগ বুঝে দেশের বাইরে চলে গেলেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ-সদস্য দেশের ভেতরেই লুকিয়ে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, এরা আত্মগোপনে থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এমনকি বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করতেও তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছিলেন গোপালগঞ্জ-৩ আসনের। তিনি আছেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ আসনের ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ঢাকাতেই আত্মগোপনে আছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী এবং নোয়াখালী-৫ আসনের ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে। সব সময় নানা বিষয়ে মিডিয়ার সামনে অসংলগ্ন কথা বলা এই রাজনীতিক ৫ আগস্টের পর থেকেই লাপাত্তা।
এছাড়াও আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য এবং আলোচিত সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ঢাকা-১২ আসনের আসাদুজ্জামান খান কামাল (ভারত), আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা-১৩ আসনের জাহাঙ্গীর কবির নানক (ভারত), সাবেক অর্থমন্ত্রী ও দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলী (যুক্তরাষ্ট্র), সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ও দিনাজপুর-৫ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং পিরোজপুর-১ আসনের অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম (লন্ডন), আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, চট্টগ্রাম-৭ আসনের ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (বেলজিয়াম), সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও চট্টগ্রাম-৯ আসনের মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (যুক্তরাষ্ট্র), সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সাইফুজ্জামান চৌধুরী (লন্ডন), সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং নেত্রকোনা-২ আসনের আশরাফ আলী খান খসরু (ভারত), সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী ও গাজীপুর-১ আসনের আ ক ম মোজাম্মেল হক (ভারত), আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও ফরিদপুর-১ আসনের আব্দুর রহমান (ভারত), আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেকমন্ত্রী, শেখ হাসিনার আত্মীয় ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের শেখ ফজলুল করিম সেলিম (ঢাকা), সাবেক রেলপথমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ আসনের মুজিবুল হক মুজিব (আগরতলা), সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এবং চাঁদপুর-২ আসনের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (ভারত), সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাবেক একেএমএ আবুল মোমেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০ আসনের আ হ ম মুস্তাফা কামাল, সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী এবং মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য জাহিদ মালেক।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী ও দিনাজপুর-২ আসনের খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (লন্ডন), সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের শাহরিয়ার আলম, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও মাগুরা-২ আসনের বীরেন শিকদার (কলকাতা), সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং লালমনিরহাট-১ আসনের মো. মোতাহার হোসেন (ঢাকা), সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা-১৭ আসনের মোহাম্মদ এ আরাফাত (যুক্তরাষ্ট্র), সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-২ আসনের জাহিদ আহসান রাসেল (ভারত), সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-৩ আসনের রুমানা আলী (ঢাকা), সাবেক নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-৪ আসনের সিমিন হোসেন (ঢাকা), সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-৩ আসনের রুমানা আলী, সাবেক রেলপথ প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-২ আসনের জিল্লুল হাকিম, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের কাজী কেরামত আলী, সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী এবং জামালপুর-৩ আসনের মির্জা আজম (ভারত)। এছাড়াও সাবেক পানিসম্পদ উপমন্ত্রী ও শরীয়তপুর-২ আসনের একেএম এনামুল হক শামীমও (ভারত) ৫ আগস্টের পর থেকেই আত্মগোপনে।
এছাড়াও আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী সংসদ-সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক চিফ হুইপ ও বরিশাল-১ আসনের আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ (ভারত), দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের মাহবুবউল আলম হানিফ (কানাডা), আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনের আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম (ভারত), সাবেক চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই-আলম চৌধুরী (ভারত), সাবেক হুইপ ও দিনাজপুর-৩ আসনের ইকবালুর রহিম (কলকাতা), সাবেক হুইপ ও চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (কলকাতা), আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক হুইপ ও জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন (কলকাতা), সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক হুইপ ও নড়াইল-২ আসনের মাশরাফি বিন মুর্তজা, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের একেএম শামীম ওসমান, সিলেট-২ আসনের শফিকুর রহমান চৌধুরী (লন্ডন), কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার (ভারত), ফেনী-১ আসনের আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম (আমেরিকা), ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারী (সিঙ্গাপুর), ক্রিকেটার ও মাগুরা-১ আসনের সাকিব আল হাসান (যুক্তরাষ্ট্রে), শেখ হাসিনার আত্মীয় ও বাগেরহাট-১ আসনের শেখ হেলাল উদ্দীন (ভারত), শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় ও বাগেরহাট-২ আসনের শেখ সারহা নাসের তন্ময় (লন্ডন), নিষিদ্ধ সংসগঠন ছাত্র লীগের সাবেক নেতা ও বাগেরহাট-৪ আসনের এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ (ভারত), শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় ও খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল (আমেরিকা), আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা-৩ আসনের এসএম কামাল হোসেন (ভারত), যুবলীগ নেতা ও ভোলা-৩ আসনের নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন (ভারত), টাঙ্গাইল-২ আসনের ছোট মনির (ভারত), টাঙ্গাইল-৭ আসনের খান আহমেদ শুভ (ভারত), টাঙ্গাইল-৮ আসনের অনুপম শাহজাহান জয় (ভারত), অভিনেতা ও ঢাকা-১০ ফেরদৌস আহমেদ (আমেরিকা), যুবলীগের সভাপতি ও ঢাকা-১৪ আসনের মাইনুল হোসেন খান নিখিল (ভারত), নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও গাইবান্ধা-৫ আসনের মাহমুদ হাসান রিপন (কলকাতা), রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরী, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য একেএমএ আউয়াল (ভারত)।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টে শহিদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৫৮ জন। পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, শুধু ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্তত ৪১০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হাসিনার পাশাপাশি তার সরকারের মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদেরও আসামি করা হয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কতটি হত্যা এবং হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে, সেটির পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকারের সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি গুলি করে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, অপহরণ ও গুমের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অব্যাহত রয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ২৯ জন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হয়েছেন আরও ৬ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী। এর বাইরে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ৪২ জন সংসদ-সদস্য। এদের বাইরে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত আহমেদ নাজমীন সুলতানা ও মোসা. সাফিয়া খাতুনকেও সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা সবাই ৫ আগস্টের পর থেকেই কেউ দেশে, কেউবা আবার দেশের বাইরে যে যার মতো করে আছেন আত্মগোপনে।
গ্রেফতারকৃত মন্ত্রীদের মধ্যে শুধু সাবের হোসেন চৌধুরী এবং এমএ মান্নান জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। অন্যরা গণহত্যাসহ একাধিক মামলায় কারাগারে বিচারাধীন।