বেক্সিমকোর ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি
বাঁচানো গেল না ১৪ প্রতিষ্ঠান * সরকারের খরচ হবে ৫২৫ কোটি টাকা

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-6757610aabd21-67c0dee9305d9.jpg)
ঋণের ভারে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না বেক্সিমকো গ্রুপের ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে। তহবিল সংকট ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে না পারায় বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আওতায় এসব প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলো।
বেশ কিছুদিন আগ থেকেই পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রি. জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের বিস্তারিত তুলে ধরেন। বলেন, পাওনা পরিশোধে সরকারের খরচ হচ্ছে ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা অর্থ বিভাগ এবং বাকি ২০০ কোটি টাকা শ্রম মন্ত্রণালয় ঋণ হিসাবে দিচ্ছে।
ওই টাকায় ৩১ হাজার ৬৬৯ জন শ্রমিক এবং এক হাজার ৫৬৫ জন কর্মকর্তার পাওনা পরিশোধ করা হবে। আগামী ৯ মার্চ থেকে এ পাওনা পরিশোধ শুরু হবে। বেক্সিমকো শিল্পপার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
উপদেষ্টা বলেন, বেক্সিমকো শিল্পপার্কের নামে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে ১৩টি ব্যাংক জড়িত। ২০০৮-২০২৪ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের জন্য দায়ী ও জড়িত কর্মকর্তা, ব্যাংকের বোর্ড সদস্য, কোম্পানি বোর্ড সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) সংশ্লিষ্ট অন্য সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়ী প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ঋণ প্রদানে জড়িতরা যেন দেশের বাইরে যেতে না পারেন, সেজন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, এটা মনে কইরেন না যে বিদেশে চলে গেছেন বেঁচে গেছেন। বিদেশে যারা গেছে, হয় তারা আসবে, না হয় সেখানে আটকা পড়বে। আমি জানি না তাদের কী হবে। আমি ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি, দরকার হলে তদন্তের পরে ওনাদের পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, যারা বিদেশে চলে গেছেন আমি তাদের অনুরোধ করব, আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। তদন্তের মুখোমুখি হন, যদি নির্দোষ হন বিদেশেই থাকবেন। তিনি বলেন, অনেকে বিদেশে সিটিজেনশিপ কিনেছেন। সিটিজেনশিপ হলেও বাংলাদেশের আইনে সেটা প্রযোজ্য হবে বলে আমি মনে করি। বিদেশে থাকবেন আর এখানে গণ্ডগোলের মধ্যে ফেলবেন সেটা হবে না।
দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। এই গ্রুপের অন্যতম মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ১৩ আগস্ট থেকে কারাগারে। ২৯ আগস্ট সালমান, তার পুত্র ও পুত্রবধূর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এই গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেখানে জটিলতা দেখা দেওয়ায় সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়।
বেক্সিমকোর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে এ উপদেষ্টা বলেন, দয়া করে আপনারা এমন কিছু করবেন না, যে কারণে আমাদের কঠোর হতে হয়। আমরা কঠোর হতে চাই না। সঙ্গে আমি শ্রমিকদের অনুরোধ করব, ওনারা যাতে পরিস্থিতিটা বোঝেন। আপনারা প্রত্যেকেই দেশপ্রেমিক। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, অনেকের সঙ্গে দেখা হয়নি। যাদের সঙ্গে দেখা হয়নি, তাদের প্রত্যেককে আমি সময়মতো ডাকব। আপনার এমন কিছু করবেন না বা এমন কিছু করতে দেবেন না, যার কারণে আবার সমস্যার সৃষ্টি হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, বেক্সিমকো শিল্পপার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এই ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। এ কমিটিতে সদস্য হিসাবে থাকবেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক ও অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধিসহ বেক্সিমকো লিমিটেডের রিসিভার। কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে কাজ করবেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।
গাজীপুরে বন্ধ ঘোষণার নোটিশ : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, এদিকে বুধবারই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত কারখানা বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকার বেক্সিমকো শিল্প পার্কের টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল বিভাগের ১৪টি কারখানা সম্পূর্ণভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারখানার সব শ্রমিককে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ওই নোটিশে বলা হয়েছে, বেক্সিমকো লিমিটেড (ইয়ার্ন ইউনিট-১ ব্যতীত) ও এর সংশ্লিষ্ট অপর ১৩টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শ্রমিকদের জানানো হয়, কারখানায় কোনো কাজ না থাকার কারণে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর এবং ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সর্বশেষ সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক কারখানাগুলো লে-অফ ঘোষণা করা হয়।
কাজের সংস্থান না থাকায় কারখানাগুলো ১৬ (৭) ধারা এবং তদনুযায়ী ২০ (৩) ধারা মোতাবেক কারখানার সব শ্রমিককে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ছাঁটাই করা হলো এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। ছাঁটাইকৃত সব শ্রমিককে আইন ও বিধি অনুযায়ী তাদের সব প্রাপ্য পাওনাদি প্রদান করা হবে। এই প্রাপ্য পাওনাদি আগামী ৯ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ সুপার একেএম জহিরুল ইসলাম বলেন, কারখানা এলাকায় কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। শান্তিপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন রয়েছে।