Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিটিএমএ’র সংবাদ সম্মেলন

সুতা ডাম্পিং করছে ভারত হুমকিতে দেশীয় শিল্প

গোডাউনে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে ৮-১০ হাজার কোটি টাকার সুতা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুতা ডাম্পিং করছে ভারত হুমকিতে দেশীয় শিল্প

বাংলাদেশে সুতা ডাম্পিং (উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে রপ্তানি) করছে ভারত। আর গ্যাসের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি, বর্ডার খুলে দিয়ে এবং দেশীয় সুতায় প্রণোদনা হ্রাস করে সেই সুযোগ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা। স্থলবন্দরগুলো দিয়ে অবাধে মিথ্যা ঘোষণায় সুতা ঢুকলেও নীতিনির্ধারকরা নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে দেশের টেক্সটাইল মিলগুলোকে প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের টেক্সটাইলশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এক সময় তৈরি পোশাকশিল্প ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে। রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশ তার অবস্থান হারাবে। ভারত ইতোমধ্যে পাটশিল্প নিয়ে গেছে। এখন তৈরি পোশাক নিয়ে টানাটানি করছে। 

সোমবার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে এই আশঙ্কার কথা জানান টেক্সটাইলশিল্প মালিকরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেলের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহসভাপতি ও যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম ইসলাম, সহসভাপতি আবুল কালাম, সহসভাপতি সালেউদ জামান খান, পরিচালক খোরশেদ আলম, ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার, শাহিদ আলম প্রমুখ। 

বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়লেও দেশের টেক্সটাইল মিলগুলোতে সুতা বিক্রি বাড়ছে না। মূলত বর্ডার দিয়ে অবৈধপন্থায় সুতা আসার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো এলসি ছাড়াই স্থলবন্দরগুলো দিয়ে ট্রাকভর্তি সুতা বাংলাদেশে ঢুকছে। মিথ্যা ঘোষণায় সুতা তো আসছেই। স্থলবন্দরে সুতা কাউন্ট নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি না থাকায় মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আমদানি বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত যে বাংলাদেশে সুতা ডাম্পিং করছে তার বড় প্রমাণ হচ্ছে, ভারতের স্থানীয় বাজারের চাইতে রপ্তানির সুতার দাম কম। তারা প্রণোদনা দিয়ে বাংলাদেশে সুতা রপ্তানি করছে। এ কারণে ভারতে দিন দিন কারখানার সংখ্যা বাড়ছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে। আর অন্যদিকে বাংলাদেশের কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হতে চলেছে। দেশীয় টেক্সটাইল মিল বাঁচাতে হলে অতিশিগগিরই স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিতে হবে। 

রাসেল বলেন, বিএনপি সরকারের আমলে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ ছিল। এ কারণে দেশে একের পর এক টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে এটা খুলে দেওয়া হয়। স্থলবন্দরগুলো দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ থাকলে বৈধ-অবৈধ বা মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আমদানির সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, গ্যাসের অপর্যাপ্ততা আরেকটি সংকট। এ কারণে দেশীয় মিলগুলো ঠিকমতো উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে ভারত থেকে সুতা ডাম্পিং হচ্ছে। বর্তমানে মিলগুলোতে ৮-১০ হাজার কোটি টাকার সুতা পড়ে আছে। এই সুতা বিক্রি করতে না পারলে মিলগুলো রুগ্ন হয়ে পড়বে।  

বিটিএমএ সহসভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সুতা উৎপাদন খরচ একই হলেও ভারত কম মূল্যে বাংলাদেশে সুতা ডাম্পিং করছে। এটা তারা করতে পেরেছে, কারণ বাংলাদেশ মিলগুলো গ্যাস সংকটে ভুগছে ও দেশীয় সুতা ব্যবহারের প্রণোদনা কমিয়েছে। অন্যদিকে ভারত সরকার রোড ট্যাপসহ নানা নাম দিয়ে সুতা রপ্তানিতে প্রণোদনা দিচ্ছে। ভারত সরকার সে দেশের ব্যবসায়ীদের কেজিপ্রতি সুতা রপ্তানিতে ১১ রুপি প্রণোদনা দিচ্ছে। লেভেল প্লেয়িং তৈরি করতে না পারলে দেশীয় মিলগুলো আরও সংকটে পড়বে। তিনি আরও বলেন, বিগত সরকার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে গ্যাসের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। সার কারখানা, গৃহস্থালি, চা বাগানে ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস দিলেও টেক্সটাইল শিল্পের ক্যাপটিভে দামের বোঝা চাপানো হয়েছে। ওইসব খাতে ভর্তুকির দায়ভার টেক্সটাইল শিল্পকে টানতে হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা কুইক রেন্টালকে প্রণোদনা হিসাবে দেওয়া হয়েছে। টেক্সটাইলশিল্পকে ধ্বংস করতে এর চেয়ে সুন্দর পরিকল্পনা আর হতে পারে না। গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ২০ টাকা করার দাবি জানান তিনি। স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা ও কাপড় ডাম্পিং মূল্যে প্রবেশ করছে অভিযোগ করে সালেউদ জামান বলেন, স্থলবন্দরগুলোতে সুতা পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। ৩০ কাউন্টের সুতা ঘোষণা দিয়ে ৮০ কাউন্টের সুতা আসছে। তার ওপর আংশিক শিপমেন্টের অনুমতি দেওয়া আছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের আগ পর্যন্ত স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ রাখতে হবে। 

গার্মেন্ট মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভারত টেক্সটাইলশিল্পের বিকাশে ১০ বছরের নীতি গ্রহণ করেছে। তারা এখন ডাম্পিং মূল্যে গার্মেন্টকে সুতা দিচ্ছে। যখন বাংলাদেশে টেক্সটাইলশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন তারা আর সুতা দেবে না। পরে পুরো তৈরি পোশাকশিল্পের অর্ডার ভারতে চলে যাবে। তখন চেষ্টা করে কেউ কিছু করতে পারবে না। তাই এখনই সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। 

সহসভাপতি আবুল কালাম বলেন, শুধু দেশের টেক্সটাইলশিল্পকে বাঁচাতে বিএনপি সরকার স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে টেক্সটাইলশিল্পের ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থান হয়েছে, রপ্তানি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বর্ডার খুলে দেয়। এ কারণে একের পর এক শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ দিতে পারছে না অনেক উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ব্যাংকের ঋণ, গ্যাস বিল ও শ্রমিকের বেতন দিতে পারছি না। বর্তমানে ৩ মাসের আয় দিয়ে এক মাসের খরচ মেটানো যাচ্ছে। স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নৌপথে সুতা আমদানি করার সুযোগ থাকুক। তাতে টেক্সটাইল মিলমালিকদের আপত্তি নেই। তাছাড়া এক বছর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও এখন আবার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কার স্বার্থে এই শিল্পকে ধ্বংস করতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে তা বোধগম্য নয়। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদহারে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি। 

বিটিএমএ পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজিব হায়দার বলেন, জ্বালানি আমদানিনির্ভর কোনো দেশ শিল্প খাতে টেকসই উৎপাদন করতে পারবে না। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম কম দামে জ্বালানি দিতে পারায় সেই সব দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে। পক্ষান্তরে আমরা গ্যাসের মূল্য অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। এমনভাবে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, যা দেখে মনে হয় পুরো গ্যাস খাতকে আমদানিনির্ভর করে ফেলা হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণে স্থানীয় উৎপাদনকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। এ রকম ভ্রান্তনীতির ওপর গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হলে শিল্পের সক্ষমতা তো দূরের কথা, শিল্প ধ্বংস হবেই। মাটির নিচে গ্যাস রেখে আমদানি করা এলএনজি ৭৫ টাকায় বিক্রি করা হবে কার স্বার্থে। তিনি বলেন, নতুন কূপ খননে মনোযোগী হলে গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ২০-২২ টাকা বেশি হওয়ার কথা নয়। 

তিনি আরও বলেন, কোনো অবস্থায় গ্যাসের বাড়তি দাম মেনে নেওয়া হবে না। এবারের বিইআরসির বৈঠকে কোনো কথা না বলে আমাদের উত্তর হওয়া উচিত, ৫০০ কারখানার চাবি জমা দেওয়া। তারা গ্যাসের হিসাব আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্যাসের দাম ৮০ টাকা করলেও সমস্যা নেই। একতরফা কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। মিল বন্ধ করে সব চাবি দিয়ে দেওয়া হবে। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়ছেই। 

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ভারতীয় সুতা আমদানিতে এন্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপের উদ্যোগ গ্রহণ করা। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এক্ষেত্রে ভারত সরকার যতটা তৎপর, বাংলাদেশ সরকার ততটা তৎপর নয়। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের টনক নড়ে। তুলার দাম বেড়ে গেলে ভারত তুলা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ চিনির সংকট হলে পরিশোধিত চিনি এবং বই ছাপাতে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করে। তার মানে সরকারই শিল্প মেরে ফেলছে। তিনি আরও বলেন, আন্দোলন করা ব্যবসায়ীদের কাজ নয়। সহযোগিতা না পেলে সরকারের হাতে কারখানার চাবি তুলে দেওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে করি। ২০২৪ সালে ভারত থেকে ৪০ শতাংশ সুতা আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার মানে বাংলাদেশের সুতা বিক্রি হচ্ছে না। অবৈধভাবে সুতা আমদানি তো হচ্ছেই। ওরা (ভারত) পাটশিল্প নিয়ে গেছে। এখন তৈরি পোশাক নিয়ে টানাটানি করছে।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম