জাতিসংঘের অনুসন্ধান
দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে অতিষ্ঠ ছিল মানুষ

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনে ক্ষমতার উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি হয়েছে। আমলাতন্ত্র ও নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন ব্যাপক দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি করেছে। এক জরিপের তথ্য অনুসারে, প্রতি চারজন বাংলাদেশির মধ্যে তিনজন (৭৪.৪ শতাংশ) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতির শিকার।
এর সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি। ফলে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, ছাত্র এবং ব্যবসায়ীদের বড় অংশ ব্যাপক ক্ষুব্ধ ছিল। এর বাইরেও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। যা জুলাই আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনের আগে সমতল মাঠ তৈরি করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা বাতিল করেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আয় ও ভোগের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দেশের সম্পদ ও আয় শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ধনীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
২০২২ সাল থেকে মধ্য ও নিম্নআয়ের বাংলাদেশিরা খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যস্ফীতির কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এর পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নীতিগুলো দায়ী। বিপরীতে সরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় ব্যয় কমিয়েছে। গত বুধবার জেনেভা কার্যালয় থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে ব্যক্তিনির্ভর নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাদের রাজনীতিতে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সব সময়ই এরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। তবে যতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল ছিল, জনগণ এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এই ব্যবস্থার অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেখানে নিয়মিতভাবে পরাজিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল।
এতে প্রমাণিত হয়, সাংবিধানিক এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনের আগে সমতল মাঠ তৈরি করে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর, আওয়ামী লীগ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। দলটি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিয়ম, সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপে জয়লাভ করে। ২০১৪ সালে বিরোধী দল বর্জন করলে নির্বাচন কলঙ্কিত হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও জয়ী হয়।
তবে ওই সময়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল। এ সময়ে বিরোধী সমাবেশ দমন এবং হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে নির্বিচারে গ্রেফতার করে সরকার। নাগরিক সমাজকেও বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো হয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে রয়েছে-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা খাত এবং সরকারি আমলাতন্ত্র। ক্রমবর্ধমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ে।
এর ফলে বিভিন্ন খাতে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা, পক্ষপাতদুষ্ট পুঁজিবাদ এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকার বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রফতানিনির্ভর শিল্প, বিশেষ করে গার্মেন্ট খাত এবং বড় অবকাঠামো প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিপরীতে ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। যদিও তারা দাবি করেছে ২০১৩ সালের পর মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক সুবিধার বণ্টন অসমভাবে হয়েছে। সেখানে ব্যাপক বৈষম্য ছিল। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আয় ও ভোগের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দেশের সম্পদ ও আয় শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ধনীদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ছাত্র এবং তরুণ জনগোষ্ঠী বেসরকারি খাতে চাকরি খুঁজে পেতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। যা তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কারণে কমে গেছে তাদের সুযোগ।
২০২৪ সালের এপ্রিলের এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৫-২৪ বছর বয়সি যুবকদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং তরুণীদের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে। ২০২২ সাল থেকে মধ্য ও নিম্নআয়ের বাংলাদেশিরা খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যস্ফীতির কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এর পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তসাপেক্ষ ঋণের কারণে গৃহীত কঠোর অর্থনৈতিক নীতিগুলো দায়ী।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় ব্যয় কমিয়েছে। কারণ ঋণের সুদ পরিশোধে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এছাড়া দেশের কর ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত। সরকারের আয় পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এতে মধ্য ও নিম্নআয়ের জনগণের ওপর বেশি বোঝা সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে।
এর অন্যতম কারণ হলো সরকারি কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির হাতে ব্যাংক, জ্বালানি খাত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতের নিয়ন্ত্রণ। কিছু বড় ব্যাংক রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দিয়ে প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। দেশের বাইরে বিশাল অঙ্কের অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে। উচ্চপর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ের আমলাতন্ত্র ও নিরাপত্তা সংস্থা লোকজন দুর্নীতিতে জড়িত।
এক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি হয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, প্রতি চারজন বাংলাদেশির মধ্যে তিনজন (৭৪.৪ শতাংশ) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতির শিকার। অনেক শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং ছাত্র জাতিসংঘ তদন্ত দলের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।