Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অর্থনৈতিক সংক্রান্ত টাস্কফোর্স

ব্যাংকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধসহ ৩৪ সুপারিশ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধসহ ৩৪ সুপারিশ

ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিমান ভেঙে দেশি-বিদেশি পৃথক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করতে হবে। চাঁদাবাজি ও ঘুস বন্ধে গঠন করতে হবে ‘গুন্ডা প্রতিরোধ স্কোয়াড’। এমন ৩৪টি সুপারিশ দিয়েছে ‘বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ’ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স।

এসব সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সীমিত রাখা, বুড়িগঙ্গা নদীকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং বিআরটিএ, সরকারি হাসপাতাল ও মন্ত্রণালয়ের সংস্কার করা। সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

টাস্কফোর্সের সভাপতি ড. কেএএস মুর্শিদের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টাস্কফোর্স সদস্য অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান, ড. শামসুল হক, ড. ফাহমিদা খাতুন, ড. মঞ্জুর আহমেদ, একেএম ফাহিম মাশরুর, নাসিম মঞ্জুর ও ড. রুমানা হক।

বিমানকে দুই ভাগ করে পরিচালনা : ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিমান একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান। এটিকে কী করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান এবং আধুনিকায়ন করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কোনো এক্সপার্টকে এনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসাবে বসাতে হবে। বিমানের লোকসান কমাতে দুই ভাগ করে একভাগ বিদেশি সংস্থাকে দিয়ে পরিচালনা করা হবে এবং অন্যভাগ বিমানের মাধ্যমে পরিচালনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশে। সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে দুই সংস্থাই। এরপর দেখব কোন সংস্থা ভালো করেছে।

চাঁদাবাজি ও ঘুস বন্ধে ‘গুন্ডা প্রতিরোধ স্কোয়াড’ : টাস্কফোর্সের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, চাঁদাবাজি ও ঘুস লেনদেন বন্ধে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ‘গুন্ডা প্রতিরোধ স্কোয়াড’ গঠন করতে হবে। হাটবাজার, ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে এমনকি সরকারি সেবা পেতে অনৈতিক লেনদেন বা ঘুস বন্ধেও এ স্কোয়াড কাজে লাগবে।

পাশাপাশি সরকারি সেবা পেতেও অনেক সময় ঘুস দিতে হয়। এ ধরনের অনৈতিক লেনদেনের সমস্যা সরকারি সেবার বাইরে বেসরকারি খাতেও বিস্তৃত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের সভাপতি ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ বলেন, যেহেতু সরকারের সাধারণ বাহিনী দিয়ে এগুলো দমন করা যায়নি, তাই এ বিশেষ স্কোয়াড গঠনের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এটি পরীক্ষামূলকভাবে করা যেতে পারে। এই স্কোয়াড গঠনে সরকারি সংস্থার সদস্যদের দিয়ে কিংবা বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মীও নেওয়া যেতে পারে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসন নিশ্চিত করা : বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সুপারিশে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংস্কার কমিশন (রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন) গঠনের কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ড. মুর্শিদ বলেন, আইনকানুন-নিয়মনীতির অতি নিয়ন্ত্রণ এবং আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাধা সৃষ্টি করছে। এজন্য একটি সংস্কার কমিশন গঠন অপরিহার্য। টাস্কফোর্সের সুপারিশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, পেশাদারদের দিয়ে সরকারি পর্যায়ে নেতৃত্ব গঠন, সরকারি সেবা সহজ করা, বাজারের চাহিদা অনুসারে শ্রমশক্তি প্রস্তুত করা, রপ্তানি বৈচিত্র্যময় করা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং নিত্যপণ্যের মজুত বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয় সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে নানা ধরনের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি জায়গায় ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করা, রপ্তানি বাড়াতে দুটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে। একটি হলো-উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় খাতগুলোয় নানা ধরনের নীতিসহায়তা দেওয়া। অন্যটি হলো-তৈরি পোশাকের বাইরে প্রায় দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বছরে ১০ লাখ ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে। এসব প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দিতে হবে।

এছাড়া অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার বৃদ্ধিকে কৌশলগত অগ্রাধিকারে আনতে হবে বলে মনে করছে কমিশন।

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ : টাস্কফোর্স বলেছে, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা দরকার। কেননা দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতি একাডেমিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

এ প্রসঙ্গে ড. কেএএস মুর্শিদ বলেন, গত ৫০ বছরে ক্যাম্পাসে অনেক রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু আমরা ভালো কোনো ফল দেখিনি। এশীয় মহাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নেই।

ছাত্ররা নিজেদের দাবিদাওয়া এমনকি সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করতে পারে। তাই বলে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে আরও যেসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো-যেকোনো পরিস্থিতিতে অটোপাশ বন্ধ করা। জিপিএ-৫ পদ্ধতি কোচিংনির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে রাখতে হবে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা : প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করা হলে সাধারণ মানুষের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে। ফলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা খরচের অর্থ সাশ্রয় হবে।

দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি : টাস্কফোর্স বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব অন্যতম বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদার ঘাটতি পূরণ হবে এবং ওই সনদ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এনে দুই বছরের বিএ (টেক) ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া শিল্প, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বিদেশে পাঠানো যেতে পারে।

গ্লোবাল এক্সেলেন্স সেন্টার : টাস্কফোর্স বলেছে, ঢাকা শহরতলিতে একটি ‘গ্লোবাল এক্সেলেন্স সেন্টার’ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (এসটিইএম) বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য কাজ করবে।

পাশাপাশি পরিবেশবিজ্ঞান এবং জৈব প্রযুক্তি বিষয়েও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করবে। ভারতের আইআইটি-সহ আন্তর্জাতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে এটি গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে। সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ারাল চেঞ্জ কমিউনিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য গবেষণায় মনোযোগ দেবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাত থেকে রাজনৈতিক প্রভাব অপসারণ করতে হবে।

একটি শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে এ খাতটিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ভেঙে ফেলা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশোধনী বিল ২০০৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। একটি একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

ড. শামসুল হক বলেন, প্রতিবছর ১৩ থেকে ১৪শ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এগুলোর ব্যবস্থাপনা কঠিন। তবে এদেশে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়া এবং অর্থ অপচয়ের অন্যতম কারণ হলো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ঠিকমতো হয় না। যেনতেনভাবে ঘরে বসেই সমীক্ষা করা হয়। যার খেসারত দিতে হয় জনগণকে। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

টাস্কফোর্সের অন্য সুপারিশগুলো হলো-বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) পুনরুজ্জীবিত করা, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি, ডিজিটাল বিভাজন কমানো। এছাড়া পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার সংস্কার, সৌরশক্তির জন্য অবনমিত জমি ব্যবহার, সুপারিশ হাইলাইট বিভাগ ও ইনস্টিটিউট স্থাপন, সরকারি কর্মদক্ষতা উন্নত করা, ওপেন ডেটা প্ল্যাটফরমগুলো বাস্তবায়ন, জরুরি মজুত স্থাপন করা প্রভৃতি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম