মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডি
যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পার হলেও জনজীবন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি আনার পদক্ষেপ নেই। বাড়েনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি, মজুতদারিসহ অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি জরুরি। বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। সংস্থাটির মতে, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫ : সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
বক্তারা বলছেন, গত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল। বৈষম্য বেড়েছিল অনেক। ঋণের দুষ্টচক্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভুত করা উচিত। তারা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া উচিত। কারণ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার বেশিদিন থাকতে পারে না। ফলে যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’
সংস্থাটি বলছে, ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনৈতিক গতিধারার উন্নতি নেই। অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি মাত্র তিন দশমিক সাত শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে ছিল ১৭ ভাগের বেশি। সিপিডি বলছে, বিদেশি ঋণের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎসে ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আগামীতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল। গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। তাদের মতে, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। সমাজে বেড়েছিল বৈষম্য।
রিজার্ভের অবস্থা বিবেচনায় বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সংস্থাটির মতে, প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও কার্যকর এবং প্রতিযোগিতা আইন সংস্কার করতে হবে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যে ইতিবাচক গতি আছে। ইউরোপ ও মার্কিন বাজারে পোশাক রপ্তানি অনেক বাড়ছে। গত চার বছরে ৪০ লাখ শ্রমজীবী বিদেশ গেছেন। যার বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু রেমিট্যান্সে এর যৌক্তিক প্রভাব নেই। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ইতোমধ্যে ৬ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু জনজীবন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি আনার মতো কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো চাঞ্চল্য দেখছি না।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর খাতভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিকেন্দ্রিক কিছু সংস্কার আমরা লক্ষ করছি। তবে জনজীবন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি আনার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) লক্ষ্য করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একটি ত্রিমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমে প্রয়োজন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এর কারণ হলো তাদের অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে পুনরুদ্ধারে কিছুটা অবকাশ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বছরের পর বছর ধরে পুঞ্জীভূত চ্যালেঞ্জগুলো একত্রে মোকাবিলা করতে হবে। তৃতীয়ত, সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করার জন্য সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা টেকসই করা অর্থাৎ সংস্কার কর্মসূচিকে চলমান রাখা। ফাহমিদা খাতুন বলেন, অভ্যুত্থানের আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে ধাক্কা রয়েছে। অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। রাজস্ব আহরণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে ৪৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কর আহরণ বাড়াতে সরকার সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন করের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কথা বিবেচনা করে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে স্বল্প এবং নির্ধারিত আয়ের মানুষের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন (এডিপি) ৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি কর্মসংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সফলতা এখনো দেখা যায়নি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিগত সরকারের সময়ের ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি চেয়ে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিল সিপিডি। তবে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে এই যুক্তি তুলে ধরে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য সরকার দেয়নি বলে অভিযোগ করেন ফাহমিদা খাতুন। আমরা চাই, সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে সময়ে মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর। সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। তিনি বলেন, জনগণ যে কর দেয়, সরকার পুরোপুরি পায় না। সুযোগ ছিল এসব জায়গায় হাত দেওয়ার। কিন্তু দেয়নি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেনি ভ্যাট বাড়াতে। তারা বলেছে যে কোনো উপায়ে রাজস্ব বাড়াতে। কিন্তু সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ কর বাড়াচ্ছে।
ঋণের দুষ্টচক্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত : ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে। জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে। এজন্য মূলত পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। এই সংকট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২১ হাজার কোটি টাকা পাওনা। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া প্রায় ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি আইপিপি এবং সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কারণে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পাওনা মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি আমদানির জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে মোট ৭২২ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে পেট্রোবাংলার। অন্যদিকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য শেভরন বাংলাদেশের কাছে ২২২.৫৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এদিকে পেট্রোবাংলার কাছে ৩৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ভ্যাট বকেয়া রয়েছে এনবিআরের।
লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করতে হবে : দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা উচিত। ব্যাংকের লাইসেন্স বন্ধ করতে হবে। একই ব্যক্তি যাতে একাধিক ব্যাংকের মালিক হতে না পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাত দুর্বল হওয়ার পেছনে যেসব গভর্নর দায়ী তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজার নিয়ন্ত্রণে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স : ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার অত্যাবশকীয় পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি, মজুতদারিসহ অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের নজরদারির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া কোনো পদক্ষেপ এখনো জনজীবনে স্বস্তি আনতে পারেনি। ১৪টি খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক ওঠানামার জন্য মজুতদারি, কমিশন বাণিজ্য বড় প্রভাব রেখেছে। সরকার খাদ্যপণ্য সরবরাহ পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।