অস্থিরতা ও ক্ষোভ সিদ্ধান্ত বদল
জনমনে প্রশ্ন প্রশাসনে হচ্ছেটা কী
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রশাসনে নিয়োগ বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক সময় প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ জারি করেও তা টেকাতে পারছে না সরকার। বিশেষ করে ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর স্থির থাকতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এতে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত ২২৭ জনকে একবার বাদ দেওয়া, ফের তাদের কয়েকজনকে যোগদানের সুযোগের ঘোষণা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ৬ সদস্যকে নিয়োগ এরপর তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়।সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলা হয় মহার্ঘভাতা ঘোষণা করা হবে।
এমন ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। বিগত সরকারের সময় বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর এ সংক্রান্ত আদেশ জারি হয়নি। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বয়স সীমা দুই বছর বাড়লেও অবসরের বয়স বৃদ্ধিসংক্রান্ত কোনো ঘোষণা আসেনি। ডিসি পদে নিয়োগ নিয়ে দফায় দফায় আদেশ বদল।
সচিব নিয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা বাতিল, এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একজনকে ওএসডি করাসহ আরও অনেক ঘটনাও ঘটেছে গত কয়েক মাসে। এসব কারণে প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এতে প্রশাসনের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনে আসলে হচ্ছেটা কী?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ সিদ্ধান্তই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে নিতে পারেনি। উপরের মহল থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই ভাবে চাপের মুখে কোনো কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হয়েছে। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা সামনে চলে আসছে। আন্দোলনের মুখে গত সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রশাসনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান দেশের (পর্তুগাল) বাইরে সফরে আছেন। তিনি ফিরবেন ৩০ জানুয়ারি। অতিরিক্ত সচিব নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) মো. ওবায়দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত তামিল করাই তাদের কাজ। এর বাইরে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, সরকারের অনেক উপদেষ্টা প্রশাসন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তারা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। তিনি বলেন স্থিতিশীল পরিবেশ না আসা পর্যন্ত এসব বন্ধ হবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৩ জানুয়ারি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ছয় সদস্যের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। অথচ তারা বর্তমান আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগের আগে তাদের বিষয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, জেলা প্রশাসন কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রতিবেদন সংগ্রহ করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খানকে প্রধান করে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে বর্তমান সরকার। ১০ ডিসেম্বর কমিটি ৭৬৪ জনকে বিভিন্ন স্তরে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে। বিষয়টি ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হয়। কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত দেওয়ার প্রায় দেড় মাসেও এ বিষয়ে কোনো আদেশ জারি হয়নি।
এসব বিষয়ে সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, সিদ্ধান্ত নিয়ে তা পরিবর্তন করা প্রশাসনের দুর্বলতার বহির্প্রকাশ। এতে জনগণের মনে হতে পারে সরকার এবং প্রশাসনের কর্তারা পারছেন না। তারা সঠিক লোকটাকে সঠিক জায়গায় বসাতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসা ব্যক্তি নির্বাচন স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়নি। তাদের অভিজ্ঞতারও ব্যাপক ঘাটতি আছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে প্রায় ১৩ বছর সার্ভিসের বাইরে ছিলেন এবং বর্তমান প্রশাসন সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা টেকাতে পারছে না সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সেপ্টেম্বরে বিসিএস ২৪, ২৫ এবং ২৭ ব্যাচের ৬০০ কর্মকর্তার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ফিটলিস্ট তৈরি ও নিয়োগ চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ৪ মাস পর ফের ডিসির ফিটলিস্ট তৈরি করা হচ্ছে। ৪ মাসের মাথায় নতুন করে ডিসির ফিটলিস্ট তৈরি করা নিয়ে প্রশাসনে অস্থিরতা রয়েছে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২ বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করা হয়েছে। অতীতে যাতবার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বেড়েছে, একই সঙ্গে অবসরের বয়সও বেড়েছে। কিন্তু এবার অবসরের বয়সসীমা বাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে সব গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনে এখনো স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে কিছু ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এতে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ সবের লাগাম টানা দরকার। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের তর্কিত সিদ্ধান্ত প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে। গণমানুষের কাছে প্রশাসন সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে। অবসরের বয়সসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, কমপক্ষে এক বছর অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত ছিল।
সম্পতি জনপ্রশাসন সচিব আনুষ্ঠানিক ভাবে বলেছেন সরকার কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। ২-৩টি মিটিং করে মহার্ঘ ভাতার হার ঘোষণা করা করা হবে। এখন বলা হচ্ছে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার মতো অর্থ সরকারের নেই। বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। মহার্ঘ ভাতার দাবিতে কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেও সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ২২৭ জন বাদ দিয়ে ১০ জানুয়ারি যোগদানের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এরপর বাদ পড়া সুপারিশপ্রাপ্তরা পরপর ২ দিন সচিবালয়ের সামনে সমবেত হন। তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন এবং নিয়োগের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এসব চলা অবস্থায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়। ২২৭ জনের মধ্যে অধিকাংশ কর্মকর্তা যোগদান করতে পারবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
৩০ ডিসেম্বর এক আদেশে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তৌফিকুর রহমানকে নারায়ণগঞ্জের ডিসি হিসাবে বদলি করা হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সচিব (উপ-সচিব) শামীম আরা রিনিকে কুষ্টিয়ার নতুন জেলা প্রশাসক করা হয়। এর আগে ৩ ডিসেম্বর অর্থ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ হাবিবুল্লাকে রাঙামাটি জেলার ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
৯ জানুয়ারি আগের সব নিয়োগ বাতিল করে অর্থ বিভাগের উপ-সচিব এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারকে রাঙামাটি এবং রাজবাড়ীর ডিসি জাহিদুল ইসলাম মিঞাকে নারায়ণগঞ্জের ডিসি হিসাবে পদায়ন করা হয়। এর আগে সেপ্টেম্বরে ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কে জড়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ১০ সেপ্টেম্বর ৫৭ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই তালিকায় বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত উপ-সচিবদের নাম ছিল না। বরং বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত কিছু উপ-সচিবকে ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিতর্ক সৃষ্টি হলে একদিন পর ৯ জেলার ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়।
গত বছর ১ অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা দুদকের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি এলাহী দাদ খানকে। নিয়োগের ২৪ ঘণ্টার মাথায় তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। নৌ-পরিবহণ সচিব একেএম মতিউর রহমানকে নিয়োগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওএসডি করা হয়। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে শতাধিক কবিতা ও বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।