Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ গ্রাফিতি নিয়ে তুঘলকি

পালের গোদা রাখাল রাহা

হুমায়ুন কবির

হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পালের গোদা রাখাল রাহা

নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের কিছু সংশোধন ও পরিমার্জন নিয়ে বেশ বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি প্রত্যাহার করা হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে জাতীয় পতাকা ও সংগীত সবশেষে ছাপানো হয়েছে। এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহিদ আবু সাঈদের মৃত্যুর তারিখ নিয়েও নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থী ও সচেতন অভিভাবকরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।

এনসিটিবির পাঠ্যবইয়ের সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির অন্যতম সদস্য রাখাল রাহাকে এসব বিতর্কের মূল হোতা বলে অভিযোগ তুলেছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাকে নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ দেওয়া এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী অখণ্ড ভারতের কল্পিত গ্রাফিতি সংযোজনের অভিযোগে পাঠ্যপুস্তক কমিটির সদস্য রাখাল রাহার অপসারণ এবং জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

জানা যায়, নতুন শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন এর বাতিল দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পরে সরকার সেটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ সংস্করণ থেকে সেটি সরিয়ে ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’ নতুন একটি গ্রাফিতি সংযুক্ত করা হয়। এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানায় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুপক্ষের মধ্যে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে আহত হয়েছেন। মামলাও হয়েছে। এ ঘটনায় আরিফুল কবির ও আব্বাস মিয়া নামে দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

এদিকে প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার বাংলা বইয়ের শেষ পাতায় জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি রাখা নিয়েও বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর আগে কখনো এমন নজির নেই। সব সময় বইয়ে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি শুরুতে স্থান পেয়েছে। এ নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাসংশ্ল্নিষ্টরা।

সমালোচনা করছেন শিক্ষাবিদরাও। এমন পরিবর্তন আনার ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, বই পরিমার্জন কমিটির সদস্য রাখাল রাহাসহ যারা ছিলেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানান, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘আদিবাসী’ গ্রাফিতি ছাপানোর জন্য পাঠ্যপুস্তক কমিটির সদস্য রাখাল রাহা স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। এরপর সেটি চূড়ান্তভাবে প্রেসে গেছে। এছাড়া প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে জাতীয় পতাকা ও সংগীত সবশেষে ছাপানো বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছিল সদস্য রাখাল রাহার। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে শহিদ নাফিসা হোসেনের নাম ভুলভাবে ‘নাহিয়ান’ ছাপানো হয়েছিল, সেটিরও দায়িত্বে ছিলেন রাখাল রাহা। তবে এসব বিতর্কের দায় এনসিটিবির চেয়ারম্যান কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে জুলাইয়ের শহিদদের নাম ও তারিখ ভুল বিষয়টি এক ধরনের ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। যারা জ্ঞাতসারে এটি করেছে তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।

রাখাল রাহার প্রকৃত নাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার প্রকৃত নাম সাজ্জাদুর রহমান হলেও তিনি সেটা ব্যবহার না করে নিজেকে রাখাল রাহা বলে পরিচয় দেন। এক্ষেত্রে তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, আমরা ভেবেই নিয়েছি আপনি একজন হিন্দুধর্মের অনুসারী। নিজের নাম গোপন করে আপনি কোন এজেন্সির হয়ে কাজ করছেন? কোন দেশের স্বার্থ হাসিল করছেন? আপনার নাম সাজ্জাদ থেকে রাখাল রাহা হলো কেন? গ্রাফিতিতে আদিবাসী দিয়ে আপনি কী বুঝিয়েছেন। তাদের মাঝেও তো বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী আছেন।

এ বিষয়ে রাখাল রাহা যুগান্তরকে বলেন, আমি পাঠ্যবইয়ের সংশোধন ও পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকলেও আমার একক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। গ্রাফিতি ‘আদিবাসী’ চূড়ান্ত স্বাক্ষরে নাম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে কেউ না কেউ দায়িত্বে থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছি।

স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি আহ্বায়ক জিয়াউল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আদিবাসী’ শব্দটি সংবিধান ও দেশবিরোধী। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে। পাশাপাশি সেখানে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এ দেশের নাগরিক। আমরা চাই, এ দেশের সবার জন্য সমান আইন নিশ্চিত হোক। পাঠ্যবইয়ে তাদের আদিবাসী বলে বিতর্ক তৈরি করছে।

এটি এক ধরনের ষড়যন্ত্র। তবে এসব ঘটনার মূলহোতা এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক কমিটির সদস্য সাজ্জাদুর রহমান ওরফে রাখাল রাহা। তিনি দেশকে অস্থিতিশীল করতে এই ধরনের কাজ করছেন। সেদিন এনসিটিবির সামনে তার নির্দেশে মারামারি হয়েছে। অতিদ্রুত তাকে এনসিটিবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বইয়ের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেছি। পাঠ্যবইয়ে যেসব গ্রাফিতি ছাপানো হয়েছে সেগুলো আমাদের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, সেখানে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। তবে বাংলা বইয়ের দায়িত্বে সংশোধন ও পরিমার্জনে সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন রাখাল রাহা। বইয়ে যেসব ভুল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সেগুলোর দায়িত্ব পড়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের ওপর। কারণ তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।

এদিকে মঙ্গলবার দুর্নীতির অভিযোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. কামাল হোসেন এ আবেদন করেন।

তিনি জানান, সিন্ডিকেট করে ছাপাখানা মালিকরা বই ছাপার কাজ বাগিয়ে নিলেও দরপত্র যাচাই ও মূল্যায়নে পিপিআর ২০০৮-এর ৩১(৩) বিধি অনুযায়ী টেন্ডার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হলে রি-টেন্ডারের সুপারিশ করার কথা। ছাপাখানা মালিকরা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ বেশিতে টেন্ডার জমা দিলেও এনসিটিবি পুনরায় টেন্ডার না করেই কাজ দিয়ে দেয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম