Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মুক্তি পেলেন ১৭৯ বিডিআর

ষোলো বছর পর প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে

Icon

গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ষোলো বছর পর প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে

সালেহার বয়স যখন তিন মাস, তার বাবা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিডিআর) নায়েক সিগন্যাল ময়নুল হককে যেতে হয় কারাগারে। সেই সালেহা এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবাকে কাছে পেয়ে বাকরুদ্ধ। শুধু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বাবার এতটুকু স্নেহও এতদিন যার কপালে জোটেনি, আজ তার বুকে মাথা রাখাটা যে বিস্ময়!

এইটুকুন মেয়ে আর পাঁচ বছরের ছেলে (এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র) শিহাব-কাকে কতক্ষণ জড়িয়ে রাখবেন বুকে! প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে পেয়ে চোখের বাঁধ যে ভেঙে গেছে ময়নুলেরও। তিনি বলেন, আজ নতুন জীবন পেলাম। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

এ দৃশ্য বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের। শুধু ময়নুল নয়, তার মতো আরও ১৭৯ বিডিআর জওয়ান এদিন ১৬ বছরের বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হয়েছেন। এদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৪৩, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৪ ও কারাগার-২ থেকে ৯৯ জন এবং হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ১৩ জন ছাড়া পান। ফুল, মিষ্টি আর চোখের পানিতে তাদের বরণ করে নেন স্বজনেরা।

এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। বিডিআর বিদ্রোহে হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় এতদিন কারাগারে ছিলেন তারা। ২০ জানুয়ারি হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ও যাদের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয়নি-এমন দুইশ আসামিকে জামিন দেন আদালত। বুধবার সেই জামিননামা কারাগারে পৌঁছায়।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হয়। আর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে যায় ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বিডিআর বিদ্রোহে বিস্ফোরক আইনের মামলায় বৃহস্পতিবার ভোরে ১২৬ জন জওয়ানের মুক্তির আদেশ কারাগারে এসে পৌঁছায়। যাচাই-বাছাই শেষে ১২৬ জন বিডিআর জওয়ানকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে একই দিন দুপুর ১টার দিকে আরও ১০ জন জওয়ানের জামিনের কাগজ কারাগারে এসে পৌঁছলে যাচাই-বাছাই শেষে পর্যায়ক্রমে তাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়।

কারাগার চত্বরে যেন আরেক ভুবন : সিপাহী আতাউর রহমানকে নিতে কারাগারে আসেন বাবা অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেক ও ছোট ভাই আল-আমিন। আব্দুল খালেক বলেন, কত যে হয়রানি অপমানের মধ্য দিয়ে এতগুলো বছর পার করেছি তা আর কী বলব। তারপরও ছেলেকে মুক্ত দেখতে পেয়েছি, এখন মরেও সুখ পাব। ১৬ বছরে ৩২টি ঈদ আমরা কারাগারের সামনে কাটিয়েছি। আজকে ঈদের চেয়েও বেশি খুশি লাগছে।

ঢাকা সদর ব্যাটালিয়নের আরেক সিপাহি জামাল উদ্দিন খানের মেয়ে জুয়েনা জামাল ঐশী বলেন, আমার বাবাকে আমি চিনি না। বড় হয়ে শুনেছি, আমার বয়স যখন ১ বছর তখন আমার বাবাকে বিডিআর হত্যা মামলায় আসামি করে কারাগারে রাখা হয়। ১৭ বছর পর বাবার মুখ দেখতে পারব। এই অনুভূতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। কোনোদিন বাবার আদর পাইনি। আজ মন ভরে বাবাকে দেখব। ঐশী যখন কথা বলছিলেন, তার চোখের পানি টলমল করে গাল বেয়ে পড়ছিল।

এইচএসসি পাশ করে ১৮ বছর বয়সে বিডিআরে সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলেন জাহিদ। ১৬ পর কারাগারে থেকে বৃহস্পতিবার মুক্তি পেয়েছেন তিনি। স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া। বিনা অপরাধে এতগুলো বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেল।

ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটালিয়নের সিপাহি মো. এনামুল বলেন, ‘আমরা যারা নিরপরাধ ছিলাম আমাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটাইছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আমাদের সবাইকে পুনরায় চাকুরীতে বহাল করতে হবে। সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এ ঘটনায় যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে।’ তিনি বলেন, আমাদেরকে শুধু বলা হয়েছে সাক্ষ্য দিতে হবে। কার নামে সাক্ষ্য দিতে হবে আমরা কিছুই জানি না। সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠায় হাসিনা সরকার।

ঢাকা সদর ব্যাটালিয়নের সিপাহি আবু হাসান জানান, যখন বিডিআর বিদ্রোহ ঘটে তখন আমার চাকরির বয়স ছয় মাস। পিলখানাতে পাঁচটি গেট আছে, সেই পাঁচটি গেটই আমি চিনতাম না। অথচ আমাকে করা হয়েছে আসামি। যেসব সিনিয়র স্যারদের আমরা বাবা সমতুল্য সম্মান করতাম, আজকে তাদের হত্যার দায়ে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে ১৬টি বছর। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমরা যেন আমাদের হারানো সম্মান ফিরে পাই।

কাশিমপুর কারাগার-২-র গেটে হাবিলদার সোলায়মান যুগান্তরকে বলেন, আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। আমার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী ছিল না। তাও আমাকে ১৬টি বছর জেল খাটতে হয়েছে। এখন সরকারের কাছে একটাই দাবি আমার যারা চাকরির শেষ মুহূর্তে ছিলাম। তাদের সবার যেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। যাদের চাকরির মেয়াদ আছে তাদের যেন বহাল করা হয়।

স্বজনদের পাশাপাশি বিডিআর জওয়ানদের বরণ করতে কারাগারের সামনে দেখা যায় বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নেতাদেরও। পরিষদের সভাপতি ফয়জুল আলম বলেন, আমি নিজেও জেল খেটে ৬ বছর আগে মুক্তি পেয়েছি। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের তিনটি দাবি রয়েছে। দাবিগুলো হলো নিরপরাধ যারা এখনো বন্দি রয়েছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। কারামুক্ত বিডিআর জওয়ানদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। পাশাপাশি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম