সংবিধান সংস্কার কমিশনের খসড়া সুপারিশ
মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাব
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বিদ্যমান সংবিধানের মূল নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন এনে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ এতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সুপারিশ করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি’ কমিশন এই বিধানটি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবেন’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের জন্য বলেছে। প্রস্তাব করা হয়েছে-একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্বোচ্চ দুই বার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এছাড়াও সংবিধানের ৭(ক), ৭(খ), ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪১(খ), ১৪১(গ) ও ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্তি এবং এ সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফশিল সংবিধানে না রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন।
এছাড়াও ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাসসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০। নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, সরাসরি ভোটে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারাও নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। বাকি পাঁচটি আসনের সদস্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) মনোনীত করবেন। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে ৪ বছর। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম দশ ভাগ তরুণ-তরুণীর মধ্য থেকে মনোনীত করতে হবে। এজন্য জাতীয় সংসদে নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় চার সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও জমা হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের জন্য ৩১ জানুয়ারি ও বাকি পাঁচটি কমিশনকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে বা এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়, সেজন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি কমিশন বলেছে, একজন সংসদ-সদস্য একই সঙ্গে নিম্নলিখিত যে কোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। যেমন প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধান। এই বিধানটি বাস্তবায়িত হলে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি দলের প্রধান পদে থাকতে পারবেন না। কমিশন দুজন ডেপুটি স্পিকারের বিধানের সুপারিশ করেছে। যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনের সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা বলেছেন, অর্থবিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখবেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সব সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত করার সুপারিশ করেছে। সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাশ হলে এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। এছাড়াও জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের আগে উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, তাদের মূল লক্ষ্য গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করা এবং সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকানো। এজন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যাতে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ না থাকে। এ লক্ষ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা; একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কয়টি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া; প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা যাতে না হন, এমন বিধান; নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান; প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা-এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনাকে নিম্নোক্ত ভাষ্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য কমিশন সুপারিশ করছে। তারা বলেছে, আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, যারা এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আমরা সকল শহীদের প্রাণোৎসর্গকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমরা অঙ্গীকার করছি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার যে আদর্শ ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছিল। সেই সকল মহান আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি। যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহিতার চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে। সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে; জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করছি।
নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে কমিশন সুপারিশ করছে। আইনসভার নিম্নকক্ষে যে সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে তিনি সরকার গঠন করবেন। নাগরিকতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রযোগ করা হবে। কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করেছে; এই বিশেষ কার্যাবলী কিংবা সংবিধানে উল্লিখিত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন। কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করছে। কমিশন বলেছে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল ‘এনসিসি’ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এনসিসির সদস্য হবেন : অ. রাষ্ট্রপতি; আ. প্রধানমন্ত্রী; ই. বিরোধীদলীয় নেতা; ঈ. নিম্নকক্ষের স্পিকার; উ. উচ্চকক্ষের স্পিকার; উ. বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি; ঋ. বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার; ও. বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার; ঔ. প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্য ব্যতীত, আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সকল সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত একজন সদস্য। উক্ত ভোট আইনসভার উভয় কক্ষ গঠনের তারিখ থেকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। জোট সরকারের ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল ব্যতীত জোটের অন্য দলের সদস্যরা উক্ত মনোনয়নে ভোট দেওয়ার যোগ্য হবেন।
এতে বলা হয়েছে, আইনসভা ভেঙে গেলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন। আইনসভা না থাকাকালীন এনসিসির যারা সদস্য হবেন অ. রাষ্ট্রপতি; আ. প্রধান উপদেষ্টা; ই. বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি; ঈ. প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুই সদস্য। এনসিসি নিম্নলিখিত পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রেরণ করবে: অ. নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; আ. অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলগণ; ই. সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; ঈ. দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; উ. মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; উ. প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার; ঋ. প্রতিরক্ষা-বাহিনীসমূহের প্রধান; এ. আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগ।
কমিশন বলেছে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে ৪ বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুই বারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। নিম্নলিখিত ভোটারদের সমন্বয়ে নির্বাচকমণ্ডলী (ইলেকটোরাল কলেজ) গঠিত হবে অ. আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য প্রতি একটি করে ভোট; আ. প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট [উদাহরণ : ৬৪ টি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ থাকলে ৬৪টি ভোট]; ই. প্রতিটি ‘সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিক ভাবে একটি করে ভোট। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কমিশন বলেছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবেন। আইনসভার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির নিকট এটা স্পষ্ট হয় যে, নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জন করতে পারছেন না, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন। একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্বোচ্চ দুই বার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যে কোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন তার জন্য এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
কমিশন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কেও সুপারিশ করেছে। তারা বলেছে, কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করছে। এই সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ (পনেরো) দিন পূর্বে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ (পনেরো) সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) দিন হবে, তবে যদি নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় তবে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ মাত্র এই সরকারের মেয়াদের অবসান ঘটবে। প্রধান উপদেষ্টা কমিশন সুপারিশ করছে যে, নিম্নোক্ত পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে আইনসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে-এনসিসির ৯ সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৭ সদস্যের সিদ্ধান্তে এনসিসির সদস্য ব্যতীত নাগরিকদের মধ্য হতে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৪.১ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না হলে, সকল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে একজন গ্রহণযোগ্য এনসিসির ৯ সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৬ সদস্যের সিদ্ধান্তে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৪.২ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না হলে, এনসিসির সকল সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৪.৩ অনুযায়ী এনসিসি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। অনুচ্ছেদ ৪.৪ অনুযায়ী যদি উক্তরূপ সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে না পাওয়া যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তা হলে তার অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একইভাবে তাকেও না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৪.৫ অনুযায়ী যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে না পাওয়া যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তবে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। অনুচ্ছেদ ৪.৬ অনুযায়ী যদি উক্তরূপ আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তা হলে তার অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একই ভাবে তাকেও না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
কমিশন উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সকল বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন করার জন্য বলেছে। কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানের সুপারিশ করেছে। এছাড়াও কমিশন অধস্তন আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় আদালত ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশন সংবিধানের অধীনে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। এছাড়াও পাঁচটি সাংবিধানিক কমিশন নিয়ে সংবিধানের একটি ভাগ তৈরির জন্য সুপারিশ করেছে। যেখানে প্রতিটি কমিশনের জন্য একটি করে পরিচ্ছেদ থাকবে। এগুলো হচ্ছে-মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন। এদের গঠন, মেয়াদ, কার্যকাল, অপসারণ প্রক্রিয়া একই রকমের হবে। প্রত্যেকটির মেয়াদ হবে ৪ বছর।