জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কলরেকর্ড ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ
ট্রাইব্যুনালে ২৫ জনের বিরুদ্ধে আবু সাঈদের পরিবারের অভিযোগ * আবু সাঈদ হত্যা মামলার অনেক আসামি এখনো স্বপদে বহাল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আওয়ামী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ ব্যক্তিদের কলরেকর্ড সিআইডিতে ফরেনসিক পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এর আগে তাদের কলরেকর্ড, অডিও এবং মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে বলে ট্রাইব্যুনালকে জানায় প্রসিকিউশন। এসব ভয়েস ও ভিডিও ফুটেজ ডিজিটালি ফরেনসিক করতে সিআইডিকে একটি রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নির্দেশনা চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়।
প্রসিকিউশনের এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সত্যতা যাচাই করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে রংপুরে নিহত শহিদ আবু সাঈদের পরিবার ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কলরেকর্ড ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ ব্যক্তি ও তাদের সহযোগীদের কলরেকর্ড, অডিও এবং মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজের সত্যতা যাচাই করতে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা আবেদন করেন। শুনানিতে প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, ভয়েস সঠিক আছে কি না, তা যাচাই ও পরীক্ষা করতে আদালতের আদেশ প্রয়োজন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন-কী পাওয়া গেছে। জবাবে প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, এন্টিএমসি থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড পেয়েছি। এ তথ্যগুলো যাচাই করতে আমরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। আলামত নষ্ট হচ্ছে। শুনানি শেষে আদালত গুরুত্বপূর্ণ কলরেকর্ডের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষার অনুমতি দেন। সিআইডি ও বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করার নির্দেশ দেন।
ইমাম হোসেন তাইম ও হৃদয় হত্যা, এসি তানজিল ও কনস্টেবল আকরামকে হাজির করার নির্দেশ : এদিকে যাত্রাবাড়ীর ইমাম হোসেন তাইম হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার পুলিশের এসি তানজিল আহমেদ এবং গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে হৃদয় হত্যাকাণ্ডে আসামি পুলিশ কনস্টেবল আকরামকে গ্রেফতার দেখানোর জন্য প্রডাকশন ওয়ারেন্ট মূলে হাজির করার আবেদনের ওপর সোমবার শুনানি হয়। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ২০ জানুয়ারি ওই দুই আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রসিকিউশন পক্ষে এ দুই আবেদনের শুনানি করেন প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মুহূর্তে হৃদয় নামের এক কিশোরকে আট থেকে ১০ জন পুলিশ সদস্য টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনে পেছন থেকে একজন পুলিশ সদস্য গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে সেই কনস্টেবল আকরামকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় ম্যাসাকার হয় যাত্রাবাড়ীতে। এসি তানজিল আহমেদ সেখানে উপস্থিত থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তার ও অন্যান্য অফিসারের নির্দেশনায় সেখানে একটি বড় হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ইমাম হোসেন তাইম একজন পুলিশের ছেলে। তাকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তানজিল আহমেদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনালে ২৫ জনের বিরুদ্ধে আবু সাঈদের পরিবারের অভিযোগ : জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে রংপুরে নিহত শহিদ আবু সাঈদের পরিবার ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, আবু সাঈদের পরিবার রংপুরে একটি মামলা করেছে। আমরা আগেও বলেছি, লোকাল কোর্টে যতই মামলা হোক, যেহেতু এটা ‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ তাই এ অভিযোগ যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসে, তাহলে সেটা প্রপার আবেদন হবে। তিনি আরও বলেন, আবু সাঈদের পরিবার নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাইব্যুনালে এসেছে। আজ তারা সেই ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ দিতে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান ও তার সঙ্গে ঘটনার সময় যেসব সহযোদ্ধা ছিলেন, তারা এসেছেন। তারা ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর টিমের পক্ষ থেকে তিনটি শুনানির আবেদন করা হয়। এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল কোনো তথ্য-উপাত্ত কোর্টে হাজির করার আগে একটা সার্টিফিকেশনের প্রয়োজন হয়। আর এ সার্টিফাইড অথরিটি হচ্ছে আমাদের সিআইডি। তারা এটা যাচাই-বাছাই করে সেটি সঠিক কি না অথবা তা ভুয়া কি না অথবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই) দিয়ে তৈরি কি না-এসব যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই-বাছাই ছাড়া এসব তথ্য-উপাত্ত কোর্টে জমা দেওয়া যায় না। এটা আন্তর্জাতিক এবং বাংলাদেশের উভয় আইনে রয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিষয়ে আমরা ডিজিটাল অনেক অ্যাভিডেন্স পেয়েছি। এখানে কলরেকর্ড, ভিডিওসহ অনেক ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স আছে। এগুলোকে ফরেনসিক চেক করার জন্য সিআইডির কাছে পাঠাতে আদালতের কাছে আবেদন করেছিলাম। তাজুল ইসলাম বলেন, পাশাপাশি সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা বা অসহযোগিতার বিষয়ে আমরা কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিচ্ছি না। কারণ, এটা চলমান একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, তথ্য সংগ্রহ চলছে। কারও বিরুদ্ধে ব্লেইম করার মতো অবস্থায় আমরা যাইনি। কোনো সংস্থা যদি তদন্তে সহযোগিতা না করে, সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পদ্ধতি আছে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলার অনেক আসামি এখনো স্বপদে বহাল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় মাত্র ২-৩ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো অনেক আসামি স্বপদে বহাল রয়েছে বলে ক্ষুব্ধ আবু সাইদের পরিবারের সদস্য ও সহযোদ্ধারা। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে এ তথ্য জানান আবু সাইদের পরিবারের সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা শেষে শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসেছি। কয়েকদিন আগে আমরা শুনেছি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সব শহিদের হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে। আমরা এসেছি সেই বিচার কার্যক্রমের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এতদিন আমরা শহিদদের হত্যার বিচার পাইনি। আবু সাঈদ হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ২-৩ জন আসামিকে ধরা হয়েছে। মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি জানতে আমরা ট্রাইব্যুনালে এসেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা এসে চিফ প্রসিকিউটর স্যারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম বিচারের কার্যক্রম খুব দ্রুত চলছে। বিচার কার্যক্রম হবে, ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত। স্যার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন শুধু আবু সাঈদের হত্যার না, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সব শহিদের হত্যার বিচার করা হবে ইনশাআল্লাহ।
আপনি বলছেন, আবু সাইদ হত্যা মামলার মাত্র দুই-তিনজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে আর এখানে এসে জানতে পারলেন এ হত্যার দ্রুত বিচার করা হবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত কি না-প্রশ্ন করা হলে আবু সাঈদের বড় ভাই বলেন, আমরা জানতে পারলাম বিচারের প্রক্রিয়া তদন্তসাপেক্ষে নিশ্চিত করা হচ্ছে। আরও জানতে পেরেছি আসামিদের গ্রেফতারের কাজ চলমান রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কাছে কী প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চাই আবু সাঈদসহ সব শহিদের হত্যার বিচারে যেন সহযোগিতা করা হয়।
আবু সাঈদের সহযোদ্ধা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী শামসুর রহমান সুমন বলেন, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড দেশবাসীসহ সারা বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। আমরা এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আমরা আশাবাদী, আগামী দিনে আবু সাঈদ হত্যা মামলার সব আসামিকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা হবে।