গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা আত্মঘাতী: আইইএফ
মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শিল্প ধ্বংস হবে * রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বন্ধ হবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাতিল, চলমান গ্যাস সংকট নিরসনে শিল্পবান্ধব এবং কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে ইন্ডাস্ট্রি এক্সিকিউটিভ ফোরাম- আইইএফ। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের নিয়ে নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম আইইএফের সদস্যরা গ্যাস খাত নিয়ে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। তারা বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শিল্প ধ্বংস হবে, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বন্ধ হবে। কারণ নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণ না করলে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারাবেন। শনিবার রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের টেক্সটাইল এবং সিরামিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী এবং ব্যবস্থাপকরা বক্তব্য রাখেন। আইইএফ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এসএইচ ফাহিমের সঞ্চালনায় ‘শিল্পোৎপাদন, সাশ্রয়ী জ্বালানি, কর্মসংস্থান ও টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষক সভায় বক্তব্য রাখেন যমুনা গ্রুপের হুরাইন হাইটেক ফেব্রিকের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাকিম, মিথিলা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মো. সাজেদুর রহমান তালুকদার, প্যারাগন সিরামিকসের সিনিয়র জিএম মোসাহেব কাক্কা ও জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্সের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) মো. শফিকুর রহমান। সভায় তারা বলেন, ২০১৯ সাল থেকে ঘন ঘন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০২২-এর জুনে ১৫.৫২%, ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ৮৭.৫০%, ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে ২.৫০% এবং ২০২৪-এর মে মাসে ২.৪৪% বৃদ্ধি হয়। সে সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা, পণ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বাধ্যবাধকতা এবং সর্বোপরি অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে শিল্প মালিকরা মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেন। যদিও গ্যাসের মূল্য অযাচিতভাবে বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশের অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং বেশ কিছু বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আইইএফ সভায় খান কনসালট্যান্সির প্রধান নির্বাহী এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের সাবেক পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন আমদানিনির্ভর না হয়ে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান করতে হবে। উন্নত কারিগরি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে গ্যাসের জন্য নিরাপদ এবং অর্থ ও সময়সাশ্রয়ী পদ্ধতির তাগিদ দেন তিনি।
অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় সংগঠন আইইএফের সদস্যরা বলেন, নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শিল্প ধ্বংস হবে, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বন্ধ হবে। কারণ নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণ না করলে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারাবেন। বাংলাদেশে শিল্প কারখানাগুলোতে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থার উত্তরণকল্পে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে শিল্পবান্ধব আধুনিক নীতিকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। গ্যাস উত্তোলন, ক্রয়, ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে হবে।
আইইএফের সদস্যরা বলেন, গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের মতামত অন্তর্ভুক্তিপূর্বক পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বিকল্প এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা, আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান এবং প্রয়োজনীয় গবেষণার ওপরেও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সংগঠনটি বলছে উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবসায়িক বাস্তবতা বিবেচনা না করে বিভিন্ন অজুহাতে দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর আরোপের ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টেকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আগে অবশ্যই শিল্পগ্রাহকদের পরামর্শ ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। আইইএফ মনে করেন রপ্তানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ, প্রয়োজনে গ্রাহকের বর্ধিত চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত মূল্য ধার্য না করা জরুরি। গ্যাস সমস্যা সমাধানে আইইএফ সভায় সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো ১) গ্যাস বিক্রি করে সরকারি মুনাফা না করা। ২) এলএনজি আমদানি থেকে শুল্ককর প্রত্যাহার করা। ৩) যে কোনো মূল্যে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করে মজুত সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ৪) শিল্প গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি/ পুনঃনির্ধারণ / শুল্ক বা কর আরোপ করা। ৫) সর্বাগ্রে যে কোনো মূল্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের চাহিদাকৃত গ্যাসের চাপ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। ৬) আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। ৭) প্রতিযোগী দেশসমূহের মতো বাংলাদেশেও নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন ও ভূমি এবং অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান এবং ৮) গ্যাসের ওপর চাপ কমানোর জন্য শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সার্বিক সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা।