Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দ্বিগুণ হচ্ছে শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম

নতুন শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষোভ

শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়ার শঙ্কা বিভিন্ন সংগঠনের * বাংলাদেশের গ্যাসনির্ভর ব্যবসা চলে যাবে পাশের দেশে, বেকার হবে লাখ লাখ শ্রমিক

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষোভ

শিল্পকারখানা ও ক্যাপটিভে নতুন সংযোগে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে, সেই দর আদায় করতে চায় তারা। পুরোনো শিল্পকারখানায় লোড বাড়াতে চাইলেও গুনতে হবে দ্বিগুণ মূল্য। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে জনিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। বিতরণ কোম্পানিগুলো ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব পাঠাবে পেট্রোবাংলা। বিইআরসি এই প্রস্তাবের ওপর শুনানি করবে। এরপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিইআরসি দাম বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেবে অথবা বাতিল করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরের বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতির (বিজিএমইএ) শীর্ষ নেতারা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে শিল্প সেক্টরে প্রভাব পড়বে। পুরো গার্মেন্ট ও সুতা সেক্টর পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে চলে যাবে। বেকার হয়ে যাবেন লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার ৪-৫ জন নেতা টেলিফোনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নেতারা অবিলম্বে জ্বালানি বিভাগের এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান। তাদের বক্তব্য, এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে আর কোনো শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে না। নতুন শিল্প টিকতে পারবে না। এ দাম দিয়ে গ্যাস কিনে কোনো শিল্পকারখানা লাভের মুখ দেখবে না। উলটো গ্যাস চুরি বেড়ে যাবে। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। জানা যায়, জ্বলানি বিভাগের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়লে গ্যাসের দাম বাড়বে। দাম কমে গেলে কমবে। দুই ধরনের দর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদিত (প্রতিশ্রুত) কিন্তু সংযোগ চালু হয়নি-এমন প্রাহকদের জন্য একরকম দর, আর নতুন শিল্পে ভিন্ন দর নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকের অর্ধেক গ্যাসের দর হবে বিদ্যমান দরের সমান, আর অর্ধেকের জন্য আমদানি মূল্য। বর্তমানে শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দর নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। অপরদিকে ক্যাপটিভে ৩০.৭৫ টাকা।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির (জি-টু-জি) আওতায় এবং স্পট মার্কেট থেকে (উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে) এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। জি-টু-জি চুক্তিতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। যে কারণে ওই দর প্রকাশ করা হয় না। তবে গত বছরের আগস্টে স্পট মার্কেটের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৭১ টাকা।

প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুমোদিত হলে প্রতিশ্রুত গ্রাহককে তার ব্যবহৃত অর্ধেক গ্যাসের জন্য ঘনমিটারপ্রতি প্রায় ৬০ টাকার মতো পড়তে পারে। অর্ধেকের জন্য বিদ্যমান দর ৩০ টাকা হারে দিতে হবে। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ৬০ টাকা হারে বিল দিতে হবে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ২৭ ডিসেম্বর এক সভায় এমন সিদ্ধান্ত নীতিগত অনুমোদন দেয়। এতে বলা হয়, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে সম্ভাব্য নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহক এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে পরিশোধ করবেন। শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে প্রতিশ্রুত (প্রাথমিক সম্মতিপত্র/চহিদাপত্র ইস্যুকৃত) গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যমান শিল্প/ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির মূল্যে প্রাপ্য হবেন। অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করবেন। একই সঙ্গে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহক অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।

এলএনজি আমদানি মূল্য বলতে দাখিলকৃত বিলের পূর্ববর্তী তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এবং স্পট এলএনজি ক্রয় বাবদ মোট ব্যয় (এলএনজি ক্রয়মূল্য, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, ভ্যাট, ট্যাক্স বিভিন্ন মার্জিনসহ সার্বিক মূল্য) গড় মূল্য বোঝাবে মর্মে জানানো হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রেরণ করা হবে। এজন্য শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহকরা অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের তথ্য (জুলাই ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪) মাসভিত্তিক বিবরণী পাঠাতে বলা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আব্দুল জলিল স্বাক্ষরিত ওই চিঠি ৬টি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, উল্লিখিত প্রস্তাব (গ্যাস ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ) বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে পাঠানোর জন্য শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহকরা অনুমোদিত লোড অপেক্ষা বেশি ব্যবহারের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। চিঠিতে ছক অনুযায়ী তথ্য দিতে বলা হয়েছে। পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আব্দুল জলিল গণমাধ্যমকে বলেন, বিতরণ কোম্পানিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে ঘনমিটার গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা। দেশীয় এসব উৎস থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে দৈনিক কমবেশি ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি আমদানি থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য ছিল ২৪.৩৮ টাকা। আর গ্যাসের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২.৮৭ টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটারে ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা আগস্টে (২০২৪) ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে (সরকারি ও আইপিপি) ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪.৭৫ টাকা ঘনমিটার এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.৭৫ টাকা ঘনমিটার করা হয়। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছিল। আর ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। গণশুনানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল ২০২২ সালের জুনে। বিদ্যুৎ ৫.০২ টাকা, ক্যাপটিভ ও সার কারখানা ১৬ টাকা, বৃহৎ শিল্পে ১১.৯৮ টাকা এবং মাঝারি শিল্প ১১.৭৮ টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণসংক্রান্ত আইন বাতিল করে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান একাধিক সভায় বলেছেন, এখন থেকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য পাওয়া গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে। শঙ্কা হচ্ছে, নতুন ফর্মুলায় শিল্পে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে, বিদ্যমান শিল্প পাবে কম দামে। নতুন শিল্প বেশি দামে গ্যাস কিনে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এতে নতুন শিল্প নিরুৎসাহিত হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম