বিক্ষোভের মুখে রাবিতে পোষ্য কোটা বাতিল
প্রশাসনে তালা, অবরুদ্ধ দুই উপ-উপাচার্য
১২ ঘণ্টা দুর্ভোগে দুইশ শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী * কোটা বহাল চেয়ে পালটা কর্মসূচি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
ইরফান তামিম, রাবি
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় সব ধরনের পোষ্য কোটা বাতিল করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কর্তৃপক্ষ। প্রশাসন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিনভর বিক্ষোভ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির হুঁশিয়ারির মুখে রাতে এ ঘোষণা আসে। বিক্ষোভের মধ্যে দুই উপ-উপাচার্যসহ দুইশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ১২ ঘণ্টা প্রশাসন ভবনে অবরুদ্ধ ছিলেন। বিশেষ প্রয়োজনেও কাউকে বের হতে বা ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জরুরি প্রয়োজনও সারতে পারেননি দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাবেক শিক্ষার্থীসহ অন্যরা। বিপরীতে পোষ্য কোটা বাতিলের প্রতিবাদে (কোটা বহাল রাখার দাবিতে) ৩ দিনের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত প্রশাসনের সময়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের জন্য ৪ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হতো। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কোটা ৩ শতাংশ ঘোষণা করে। এরপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটি বুধবার শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য কোটা বাতিল করে শুধু সহায়ক কর্মচারীদের জন্য এক শতাংশ বহাল রাখে। শিক্ষার্থীরা সেটিও বাতিল চেয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় বিক্ষোভ করে বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে তা বাতিল না হলে তালা ঝোলানোর হুঁশিয়ারি দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। পৌনে ৯টায় তারা প্রশাসন ভবন থেকে সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বের হয়ে গেলেও থেকে যান একটি অংশ। পরে সকাল ১০টায় প্রশাসন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন দুই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানসহ অন্যরা। রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত সেখানে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী অবস্থান করছিলেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে বেলা ৩টার দিকে ছাত্র উপদেষ্টা আমিরুল ইসলাম কনক এলেও তোপের মুখে ফিরে যান। সন্ধ্যা ৭টার পর অবরুদ্ধ হওয়া শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফটক খুলে দেওয়ার কথা বললে শিক্ষার্থীরা অস্বীকৃতি জানান। এতে দুপক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়।
একপর্যায়ে আটকে পড়া শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা শাবল দিয়ে ফটকের তালা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা প্রতিহত করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য করে পানি ছুড়ে মারেন। পালায় পালায় প্রায় ৪০ মিনিট পর্যন্ত এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ সময় আন্দোলনকারীরা বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন। একপর্যায়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন খান শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং প্রধান ফটকের তালা খুলে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তার অনুরোধ গ্রহণ করেননি।
রাত ৯টা ২০ মিনিটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, ছাত্র উপদেষ্টা আমিরুল ইসলামসহ বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষেরা প্রশাসন ভবনের ফটকে আসেন। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছয়জন প্রতিনিধি আলোচনার জন্য প্রশাসন ভবনের কনফারেন্স কক্ষে যান। সভায় উপাচার্য পোষ্য কোটা বাতিলের নিশ্চয়তা দেন। পরে ৯টা ৫০-এ অবরুদ্ধ থাকা দুই শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১২ ঘণ্টা পর সেখান থেকে মুক্ত হন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিজয় মিছিল বের করেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সভায় উপাচার্য সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, আমি এক শতাংশ পোষ্য কোটা রাখারও পক্ষে নই। আমি অঙ্গীকার করছি, এই পোষ্য কোটা রাখা হবে না। এই ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষেই এটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিনেন্স অনুযায়ী একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি বাতিল ঘোষণা করা হবে।’
এর আগে বিকালে উপাচার্য ফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে শুধু এ বছরের জন্য ১ শতাংশ কোটা বহাল রেখেছি। এর পরিমাণ আগামীতে বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং এটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কেন পোষ্য কোটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছে, তা আমার বোধগম্য নয়। এ ধরনের কর্মসূচি চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা। আমরা চাই না আমাদের কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
প্রশাসন ভবনে দাপ্তরিক কাজে এসে আটকা পড়েন তাপসী রাবেয়া হলের এক নারী কর্মকর্তা। মায়ের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের বয়স নব্বইয়ের বেশি। খবর এসেছে মা সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। আমাকে জরুরি ভিত্তিতে যেতে হবে। তবে আমাকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি প্রো-ভিসি স্যারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তবুও কোনোভাবে বের হতে পারিনি।’
সকাল থেকে চাকরির ভাইভার জন্য সার্টিফিকেট উত্তোলনসহ বিভিন্ন কাজে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে অনেককে। ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আতাউর রহমান শাওন বলেন, ‘পাঁচ তারিখ আমার সমন্বিত ব্যাংকে ভাইভা। কাল-পরশু বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি। আজকের মধ্যে সার্টিফিকেট তুলতে না পারলে আমি আর এই ভাইভাটাতে অংশ নিতে পারব না। আমিও শিক্ষার্থীদের এই দাবির সঙ্গে একমত। তবে চাকরিটা আমার জন্য খুবই জরুরি। এ বিষয়ে আমি প্রশাসনের সহায়তা চাই।’
বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ভিসি স্যার বাইরে আছেন। আমরা ভেতরে আছি। কোনো আলোচনা বা সংলাপ আমরা করতে পারিনি। শিক্ষার্থীরাই সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি অনেকের ভোগান্তির কথা শুনছি। শিক্ষার্থীদের আমি কল দিয়ে তাদের ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম। তবে তারা আমার কথা রাখেনি। এই মুহূর্তে আমার সরি বলা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, অবিলম্বে পোষ্য কোটা বাতিল করে মেধাবীদের মুক্তি দিতে হবে। আজকের মধ্যে পোষ্য কোটা বাতিল না করলে রোববার থেকে কমপ্লিট শাটডাউন চলবে এবং প্রত্যক একাডেমিক ভবনে তালা লাগানো হবে।
পোষ্য কোটা বাতিল ঘোষণার পরপরেই সালাউদ্দিন আম্মার সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘এই শিক্ষাবর্ষ থেকে রাবিতে আর থাকছে না পোষ্য কোটা এবং আবেদন ফি কমবে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আলহামদুলিল্লাহ আমরা বিজয়ী।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুঁশিয়ারি : সন্তানদের জন্য ১ শতাংশ পোষ্য কোটা রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ ছাড়া প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এক দিনের পূর্ণদিবস কর্মবিরতিসহ তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স সমিতির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোক্তার হোসেন।