কনকনে শীতে জবুথবু জনজীবন, দুর্ভোগ
এ মাসেই হতে পারে একাধিক শৈত্যপ্রবাহ * সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’ ‘শীতরাত’ কবিতায় এভাবেই শীতের রূপ তুলে ধরেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ।
কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে দেশ। দেখা নেই সূর্যের। বৃহস্পতিবার দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ১৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র ঠান্ডায় শ্রমজীবী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
রাজশাহী, পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট বেড়েছে। অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। ঘন কুয়াশায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। গতি কমানো হয়েছে ট্রেন চলাচলে। এদিকে বেড়েছে সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত নানা রোগ।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানান, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হতে পারে। লঘুচাপও হবে। দেশের পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কয়েকটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে একে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। আর এ তাপমাত্রা ৬ দশমিক ১ থেকে ৮ হলে মাঝারি, ৪ দশমিক ১ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তীব্র আর ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে গেলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও তাপমাত্রা এলোমেলো হচ্ছে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুরের সব কয়টি জেলায় শীত আরও তীব্র হবে। একই সঙ্গে পাহাড়ঘেঁষা শ্রীমঙ্গলেও শীত হানা দেয়। এসব এলাকায় তাপমাত্রা ৩ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণ চরমে উঠছে। এজন্য কুয়াশা ঘন হয়ে পড়ায় এর স্থায়িত্বও বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক যুগান্তরকে বলেন, তাপমাত্রা সারা বিশ্বেই এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়ছে। গা ঝলসে দেওয়ার মতো তাপমাত্রা বা হাড় হিম করার মতো ঠান্ডা-দুধরনের ঘটনাই বাড়ছে বিভিন্ন দেশে। বাড়ছে তীব্র তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহে মৃতের সংখ্যা। মাটি কিংবা পানি উভয়ের উপরিভাগে ঘন কুয়াশার স্তর সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুদূষণও এর একটি কারণ। শীতের কয়েকটা মাস ধুলো আর ধোঁয়া মিলে কার্যত রাজধানীতে কুয়াশাকে আরও কঠিন করে তুলছে।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, মধ্যরাত থেকেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে মাইলের পর মাইল। বিশেষ করে খালি জায়গায় কিছুই চোখে পড়ে না। পথশিশু-ভবঘুরে ছিন্নমূল মানুষ চরম কষ্টে গুটিশুটি মেরে সময় পার করছে। শ্রমজীবী মানুষও পড়েছে দুর্ভোগে।
খিলখাঁও রেলওয়ে এলাকায় কথা হয় বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে। তাদের মধ্যে মনোয়ারা মনু নামে এক নারী জানান, শীতের কাপড় নেই। ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। আরেকজন জানান, শীতে হাতে কাজ নেই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কমলাপুরে রানা নামে এক পথশিশু বলে, এবার কেউ শীতের কাপড় দিচ্ছে না। পলিথিন গায়ে দিয়ে পড়ে আছি। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে আগুন পোহাতে দেখা গেছে ছিন্নমূল মানুষকে।
ব্যুরো ও প্রতিনিধির পাঠানো খরব-
চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা : দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৫ শতাংশ। জেলায় বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর চাপ বেশি। অধিকাংশই ঠান্ডা আর সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে।
রংপুরে দেখা নেই সূর্যের : রংপুর মহানগরীসহ এ অঞ্চলের ৫ জেলায় ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডায় জেকে বসেছে শীত। প্রতিদিনই বাড়ছে শীতের দাপট। তিনদিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না। খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে।
হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে শীতজনিত রোগীর ভিড়। কুয়াশা ও পশ্চিমা বাতাসে বোরো বীজতলা ও আলুর আবাদ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কৃষক। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রংপুরসহ আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা এখন ১০ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। রংপুর আবহাওয়ার অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এ মাসে এই অঞ্চলে একাধিক শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহীতে তাপমাত্রা ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস : কনকনে শীত আর উত্তরের হিমেল হাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ও ৯টায় রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৩ শতাংশ। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, ডিসেম্বরের শুরুতে তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রিতে নেমেছিল। তখন হিমেল হাওয়া ছিল না। দুদিন ধরে উত্তর-পশ্চিমের কনকনে হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তাপমাত্রা বেশি নিচে না নামলেও শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে।
বগুড়ায়ও হাড় কাঁপানো শীত : জেলায় বৃহস্পতিবার দিনভর সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। সর্বনিম্ন ১১ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। প্রচণ্ড শীতের কারণে নিম্ন-আয়ের মানুষ ছাড়াও বয়োবৃদ্ধ ও শিশু কষ্ট পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় বগুড়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ বিকাল ৩টায় ১৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। শীতে স্টেশন, সড়ক বিভাজন, ফুটপাত ও খোলা স্থানে আশ্রয় নেওয়া ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট বেড়েছে।
ঘন কুয়াশা-ট্রেনের গতি কমছে : ঘন কুয়াশায় গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলরত সবকটি ট্রেন ঘন কুয়াশার কবলে পড়ছে। এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঘন কুয়াশায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালানোর নির্দেশ রয়েছে। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই ট্রেন চালাচ্ছি। যেসব সেকশনে কুয়াশার প্রভাব বেশি, সেখানে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে সিগন্যাল নির্ণয় করা হচ্ছে। যাত্রীদের জানমাল আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান।