পাচারের অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনা
চ্যালেঞ্জ সম্পদের তথ্য ঘাটতি
নিবন্ধন অধিদপ্তরে ইলেকট্রনিক ডাটাবেজ নেই * সন্দেহভাজন পাচারকারীদের তথ্য দিতে দেরি * দুবাইতে আরও ৮৫০ বাংলাদেশির তথ্য পাওয়া গেছে
প্রতীকী ছবি
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের নামে-বেনামে অর্থ পাচারের ফিরিস্তি রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে, চলছে অভ্যন্তরীণ তদন্তও। তবে সম্পদ ফেরানোয় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাচারকারীদের সম্পদের তথ্যের ঘাটতি। অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে রক্ষিত সম্পদের প্রকৃত তথ্য সরকারের কাছে না থাকায় তা উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
গত ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে পাচারকৃত সম্পদ ফেরাতে গঠিত টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে পাচারকৃত সম্পদ ফেরানোর এই চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সভায় উপস্থিত নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচারে জড়িত সন্দেহভাজনদের তথ্য দেওয়ার বিলম্বের কারণ, অধিদপ্তরের ইলেকট্রনিক ডাটাবেজ নেই। সন্দেহভাজন ব্যক্তি তথ্যপ্রাপ্তি পর তা সারা দেশের ৫৭০টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে পাঠানো হয়। অফিসগুলো ইনডেক্স (বালাম/ভলিউম) বই থেকে ব্যক্তির নাম, পিতার নাম এবং ঠিকানা দিয়ে ম্যানুয়ালি অনুসন্ধান করে তথ্য দেয়। অনুসন্ধানী সংস্থাগুলো প্রায়শই সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে তথ্য দেয়ার অনুরোধ জানায়। সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে রক্ষিত ইনডেক্স বইগুলোতে জমির মালিকের এনআইডি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, বিধায় শুধু নাম ব্যবহার করে সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। তার ওপর কিছু সাবরেজিস্ট্রি অফিস গত ৫-৭ বছরে তাদের ইনডেক্স বই আপডেট করেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানী সংস্থাগুলোর চাওয়া তথ্য প্রদান সময় বেশি লাগে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুষ্কর হয়ে পড়ে।
টাস্কফোর্সের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে অর্থ পাচারকারীদের সম্পত্তির তথ্য সংগ্রহ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে এরা সম্পদ গড়েছে। এদের সম্পদের তথ্য জানাতে নিবন্ধন অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অবস্থা এমন বেগতিক যে, গাজীপুরে এক সন্দেহভাজনের সম্পত্তি থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার প্রেক্ষিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি পাঠানো হয়। সাবরেজিস্ট্রার অফিস থেকে শূন্য প্রতিবেদন পাঠানো হয়, অর্থাৎ গাজীপুরে ওই ব্যক্তি নামে কোনো সম্পত্তির তালিকা সাবরেজিস্ট্রার অফিসে নেই। পরবর্তী পুলিশ নিজস্ব লোকবল পাঠিয়ে বালাম বই তল্লাশির মাধ্যমে ওই ব্যক্তির নামে থাকা ৭০টি সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, সম্পদ পুনরুদ্ধারের আরেকটি জটিলতা হচ্ছে, অর্থ পাচারকারীরা বেশিরভাগ সম্পদ বেনামে গড়েছেন। পর্যাপ্ত তথ্য থাকার পরও শুধু আইনি জটিলতার কারণে সেইসব সম্পদ জব্দ করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ গত ৫ বছরে দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
জাভেদের পাচারকৃত সম্পদ ফেরাতে জোর তৎপরতা : আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন এক ডজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অনুসন্ধান করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। ইতোমধ্যেই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বিদেশে সম্পদ অর্জনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও জাভেদের সম্পদের তালিকা সিআইসিতে পাঠানো হয়েছে। এইসব সম্পদ জাভেদ নিজের ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করেননি। কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় জাভেদের সম্পদ জব্দের দিকে এগোচ্ছে সিআইসি।
আয়কর আইনে (২১ ধারা) বলা আছে, আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা হয়নি- বাংলাদেশি করদাতাদের বিদেশে এমন সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেলে, করদাতা যদি সেই সম্পত্তি অর্জনের উৎস বা প্রকৃতি সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন তাহলে আয়কর বিভাগ (উপ-করকমিশনার) বিদেশে রক্ষিত সম্পত্তির ন্যায্য বাজারমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসাবে আরোপ করতে পারবে। আইনে ২১৫ (২) ধারা) আরও বলা আছে, করদাতার ব্যাংক হিসাব হতে সরাসরি সরকারের ব্যাংক হিসাব ট্রান্সফারের মাধ্যমে করদাতার বকেয়া কর আদায় করা যাবে। একই সঙ্গে ২১৭ ধারায় বলা আছে, করদাতার যেকোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, অবরুদ্ধ বা ক্রোক করে বিক্রয়ের মাধ্যমে কর আদায় করা যাবে। এছাড়া করদাতার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য রিসিভার নিয়োগ করা যাবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাভেদ আয়কর বিভাগে যেই রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাতে তার সম্পদের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। আয় দেখান ৭৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে তিনি আয়কর দিয়েছেন মাত্র ১৯ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনি সম্পদ দেখিয়েছেন মাত্র ১৭ কোটি টাকার। আর বছরে মোট আয় দেখিয়েছেন মাত্র ৭৪ লাখ টাকার। আর দুটি গাড়ি থাকলেও তিনি আয়কর ফাইলে একটির কথা উল্লেখ করেছেন। আয়কর ফাইলে দেখানো গাড়ির দাম উল্লেখ করেছেন ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা। আয়কর নথিতে ব্যাংকের স্থিতি দেখিয়েছেন ১ কোটি ৮৬ লাখ ৭২ হাজার ২৩৫ টাকা। অথচ সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ব্রিটেন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াতেও তিনি ৫শরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। যেগুলোর মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইসির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জাভেদের রিটার্ন পর্যালোচনাসহ ফাইল ওয়ার্ক প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন বিএফআইইউ থেকে প্রাপ্ত সম্পদের তালিকার বিষয়টি যাচাই করতে দুবাই সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে দুবাইতে বাংলাদেশি আরও ৮৫০ জনের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো তারা রিটার্নে প্রদর্শন করেননি। জাভেদসহ এ ধরনের ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানে পৃথক দুটি টিম শিগগিরই দুবাই যাবে।