নৌশ্রমিকদের কর্মবিরতি স্থগিত
দুদিন পর কাটল নদীপথের পণ্য পরিবহণ অচলাবস্থা
দুদিন ধরে চরম অচলাবস্থার পর পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট স্থগিত করেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। শনিবার রাতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ ঘোষণা দেন সংগঠনের নেতারা। জরুরি এ বৈঠক ডাকে অধিদপ্তর।
ধর্মঘট স্থগিতের বিষয়ে ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহআলম যুগান্তরকে বলেন, ফলপ্রসূ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ধর্মঘট স্থগিত করেছি। নৌযান শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। বৈঠকে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা উপস্থিত ছিলেন। নৌপরিবহণ এবং শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গেও আমাদের বৈঠক হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আটকা পড়েছে অন্তত ১৫ লাখ টন পণ্য। পণ্য বোঝাই করে লাইটার জাহাজ যেমন তা পরিবহণ করতে পারছে না তেমনি পণ্য লোড করার জন্য বিভিন্ন ঘাটে অপেক্ষা করছে অনেক জাহাজ। ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলছেন, নদীপথে পণ্য পরিবহণে কথায় কথায় ধর্মঘটের নামে তাদের জিম্মি করা হচ্ছে। এই ধর্মঘটের কারণে কেবল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না উৎপাদন ও পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ৫ লাখ টন পণ্য নিয়ে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ রয়েছে ২০টি বিদেশিসহ ২৩টি মাদার ভেসেল। বন্দরের বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস না হওয়ায় একেকটি জাহাজকে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার করে প্রতিদিন জরিমানা গুনতে হবে। এই জরিমানার ভার বহন করতে হবে ব্যবসায়ীদের। কাঁচামাল সংকটে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। বিভিন্ন সেক্টরে সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করলেও তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান, নির্বাচন দাবিসহ নানা কারণে বিরাজ করছে একধরনের অস্থিরতা। তার ওপর নৌপথে পণ্য পরিবহণে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সারা দেশে ভেঙে পড়েছে সরবরাহ চেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে সামনের রমজানে এর বড় খেসারত দিতে হবে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে কর্মবিরতি শুরু করে নদীপথে পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত লাইটার জাহাজের শ্রমিকেরা। মেঘনা নদীতে একটি লাইটার জাহাজের ৭ শ্রমিককে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় জড়িতদের বিচার, নিহতদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান, নৌপথে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ চার দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করলে নদীপথে পণ্য পরিবহণে অচলাবস্থা শুরু হয়। তারা এ জন্য ৭২ ঘণ্টার সময়ও বেঁধে দেয়।
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম জানান, ন্যায্য দাবিতে তারা কর্মবিরতি পালন করছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে শনিবার বিকাল পর্যন্ত কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর ও লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, সারা দেশে পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত রয়েছে অন্তত ৪ হাজার লাইটার জাহাজ। এসব জাহাজে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৬টি ঘাটসহ সারা দেশে প্রধানত ৪৫টি ঘাটে পণ্য পরিবহণ করে লাইটার জাহাজগুলো। বৃহস্পতিবার শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করলে সব কটি ঘাটেই আটকা পড়ে লাইটার জাহাজ। কোথাও পণ্যভর্তি করে আবার কোথাও পণ্য ভর্তি করার অপেক্ষায় ছিল লাইটার জাহাজগুলো। কিন্তু শ্রমিকরা কাজ না করায় পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে-তেল, র’সুগার, গম, ডাল, সয়াবিন বীজ, সার, কয়লা ও সিমেন্টের ক্লিংকারসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। ডব্লিউটিসির যুগ্ম সচিব আতাউল করিম রঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ১৬টি ঘাটসহ সারা দেশের ৪৫টি ঘাটে ৭৩৫টি জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব জাহাজে অন্তত ১০ লাখ টন পণ্য রয়েছে। আবার ২৪১টি জাহাজ রয়েছে সিরিয়ালে। অর্থাৎ পণ্য লোড করার জন্য এসব জাহাজের সিরিয়াল নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে পণ্য লোড করতে যেতে পারছে না।
সূত্র জানায়, আটকাপড়া জাহাজের মধ্যে বেশি রয়েছে, যশোরের নওয়াপাড়া, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর, মেঘনা ও সিরাজগঞ্জের ঘোড়াশাল ঘাটে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ৩৫টি জাহাজে বোঝাই করা হয় অন্তত ৫০ হাজার টন পণ্য, এসব পণ্যও গন্তব্যে পাঠানো যায়নি। আবার বন্দরের বহির্নোঙরে বিদেশি পতাকাবাহী অন্তত ২৩টি মাদার ভেসেল অপেক্ষা করছে পণ্য খালাসের জন্য। এসব জাহাজে ৫ লাখ টনের মতো পণ্য রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ৫ লাখ টন পণ্য নিয়ে ২৩টির মতো জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষা করছে। সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারলে এসব জাহাজের বিপরীতে ‘ফিক্সড অব কস্ট’ হিসেবে দৈনিক ১০ হাজার ডলার থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও ব্যবসায়ী মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। কাঁচামাল না পাওয়ায় অনেক শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, কথায় কথায় পণ্য পরিবহণ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ নৌযান ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম বলেন, ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে শ্রমিকরা নদীপথে পণ্য পৌঁছে দেন সারা দেশে। এমনকি বিগত মহামারি করোনার সময়ও তারা পণ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রেখেছিলেন। কিন্তু নদীপথ শ্রমিকদের জন্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অচল বিভিন্ন বন্দর-ঘাট : বরিশাল ব্যুরো জানায়, শনিবারও কোনো পণ্যবাহী নৌযান চলেনি। বিভিন্ন স্থান থেকে তেলসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে বহু জাহাজ কীর্তনখোলা নদীতে খালাসের অপেক্ষায় নোঙ্গর করে আছে। কিন্তু কোনো পণ্য খালাস হচ্ছে না। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন কার্গো শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বন্দরে সবধরনের পণ্য লোড-আনলোড বন্ধ থাকার তথ্য জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা।