Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা ফুটে উঠেছে পদে পদে

সিরাজুল ইসলাম

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা ফুটে উঠেছে পদে পদে

ফাইল ছবি

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতি পদে পদে ফুটে উঠেছে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা। কেপিআই এলাকা হিসাবে পুরো সচিবালয় সিসি ক্যামেরার অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেকটি ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে সিসি ক্যামেরা। কিন্তু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের ভেতরে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা বা ফুটেজ মেলেনি। ভবনের বাইরের কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে। তবে ওইসব ফুটেজ থেকে এখনো কোনো ক্লু বের করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে দায়িত্বশীল কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর সচিবালয়ের প্রত্যেকটি ভবনের ফ্লোরে ফ্লোরে কেচিগেট লাগানো থাকে। তাই ওই সময় থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কেউ এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে যেতে পারেন না। সচিবালয়ের নিরাপত্তায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দায়িত্বে থাকেন পুলিশ এবং আনসার সদস্যরা। ৫ আগস্টের পর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও। যে ভবনে আগুন লেগেছে সেই ভবনে সার্বক্ষণিক থাকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। তারপরও আগুন লাগার পর ভেতর থেকে কেউ কোনো খবর জানাতে পারেনি। আগুন যখন ৭ নম্বর ভবনের দুই পাশ থেকে দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন বাইরের লোকজন খবর দেয় ফায়ার সার্ভিসকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সচিবালয়ে প্রবেশের নির্দেশনা মানা হচ্ছিল না। গেটে যারা দায়িত্ব পালন করছিলেন তারা বেশিরভাগই নতুন। তাই যারা সচিবালয়ে প্রবেশ করেন তাদের চিনতে পারেন না। পাশ ছাড়াই অনেকে ঢুকে পড়েন সচিবালয়ে। দায়িত্বরতরা বাধা দিলে অনেকেই ধমক দিয়ে ঢুকে পড়েন। কেউ সমন্বয়ক, কেউ বঞ্চিত-এমন অজুহাতে ঢোকেন অনেকেই। এ বিষয়টিও সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, সচিবালয়ে যত্রতত্র গড়ে উঠে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের বাম পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি ক্যান্টিন। ওই ক্যান্টিনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

সূত্র আরও জানায়, অ্যালোকেশন অব বিজনেস ও সচিবালয় নির্দেশিকা অনুযায়ী, সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার কথা থাকলেও গত কয়েক বছরে এ ধরনের অভিযান চোখে পড়েনি। নিয়ম অনুযায়ী, এক মন্ত্রণালয়ের পাশ নিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু এ বিষয়টি কোনো পাশধারীকে মানতে দেখা যায়নি। এ বিষয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এ বিষয়ে বলতে হলে কমিটি বলবে। ‘আপনি তো তদন্ত কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাই আপনার কাছ থেকে একটু আপডেট জানতে চাই’-যুগান্তরের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে। আমি তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিন্তু কিছু বলার এখতিয়ার আমার নেই। কোনো অগ্রগতি থাকলে জাতীয় কমিটিই জানাবে।’ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে কোনো কিছু উদ্ধার করা গেল কিনা জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘আমি কিছুই বলব না।’

ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের অগ্রগতির বিষয়ে আমাদের লেভেল থেকে আমরা কিছু জানি না। যতটুকু জানি, বিষয়টি নিয়ে দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তিনি বলেন, অতীতের কোনো আগুনের ক্ষেত্রেই এত উচ্চপর্যায়ের কমিটি হয়নি। আশা করছি, তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে তাদের ফলাফল জানাতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্যও আমাদের কাছে নেই। এটিও তদন্তসাপেক্ষে বলা যাবে। তিনি বলেন, আমাদের একজন নিহত ও চারজন আহতের বাইরে প্রাথমিক প্রতিবেদনে আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়নি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক শনিবার বিকালে বলেন, আমি ওমরা করতে দেশের বাইরে ছিলাম। আজ ঢাকায় এসেছি। সচিবালয়ে আগুনের বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানতে পারিনি। আগামীকাল এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেব।

র‌্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। তবে এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।

সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপকমিশনার এম তানভীর আহমেদ শনিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমি ওমরায় আছি। আগুনের বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য আপনাকে দিতে পারছি না। আপনি এডিসি আবু সাঈদের সঙ্গে কথা বলুন।

এডিসি আবু সাঈদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আগুনের বিষয়ে আমি কোনো তথ্য দিতে পারব না। আপনি সিনিয়র স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

সচিবালয়ে দায়িত্বরতদের অবহেলার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক একজন মহাপরিচালক (ডিজি) যুগান্তরকে বলেন, সব ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম থাকার কথা। কিন্তু আগুন লাগার পর ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি। ভবনে থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো ছিল অকার্যকর। আগুন নেভানোর জন্য সচিবালয়ের ভেতর রিজার্ভ পানির ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, অবহেলা কোন পর্যায়ে ছিল যে, আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহত হওয়ার বিষয়টিতেই ফুটে উঠেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেপিআইয়ের ভেতর কেন ওয়াটার রিজার্ভার থাকবে না?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, কেপিআই’র মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকলেও সচিবালয়ে সেটি দেখা যায়নি। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছিল একেবারে দুর্বল। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

তিনি বলেন, ঘটনাস্থলের খুব কাছেই ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর। আবার সচিবালয়ের ভেতরেও ফায়ার স্টেশন আছে। তাহলে কেন দ্রুত সময়ে আগুন নেভানো গেল না। সচিবালয়ের সব পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা আছে, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও দেখভালের জন্য নিজস্ব জনবল আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন। আগুন লাগার সময় তারা সবাই কি একসঙ্গে ঘুমাচ্ছিলেন? এর সঙ্গে যারা জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা উচিত।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম