প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতিবাদ সভা
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবি
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবি](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/12/26/cadre-676bd6a69bdcf-676c7333c745a.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। এছাড়া কমিশন যদি কোনো ‘অযাচিত’ সুপারিশ করে, তাহলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনো তাদের সুপারিশ জমা দেয়নি। তবে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করা হবে। এরপর থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। তারা সংস্কার কমিশনের এ সুপারিশের প্রস্তাবকে বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা যৌথ প্রতিবাদ সভা করেছেন। এ সভায় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। জনপ্রশাসনের সংস্কারকে ভিন্নখাতে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে যৌথভাবে এ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) এবং বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ আদালতের একটি মীমাংসিত বিষয়ে এ ধরনের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।
বর্তমানে প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব হতে পারেন। এ পদে পদোন্নতির বিষয়ে কোটা নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও আছে। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। বর্তমানে কর্মরত উপসচিবের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৬০০। এখন সরকার গঠিত জনপ্রশাসন প্রশাসন সংস্কার কমিশন এই উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে। একই সঙ্গে কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
কিন্তু বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে প্রতিবাদের পাশাপাশি আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এমন সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির কোটা কমে যাবে বলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ ক্যাডারে কর্মকর্তা রয়েছেন ছয় হাজারের বেশি। তাদের এখন দাবি, সহকারী কমিশনার (শুরুর পদ) থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত পদগুলোর সমন্বয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসনের শতভাগ পদ হতে হবে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য। এ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের দাবিতে রোববার সচিবালয়ে বড় জমায়েত করেন।
এরকম পরিস্থিতিতে বুধবার বড় ধরনের প্রতিবাদ সভা করলেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। এতে বর্তমানে কর্মরত কনিষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা পর্যন্ত প্রতিবাদ সভায় অংশ নেন। কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিয়াম মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি হিসাবে ঢাকার বাইরের জেলা প্রশাসকরা অনলাইনে এ প্রতিবাদ সভায় অংশ নেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে শুরু হওয়া এ প্রতিবাদ সভা চলে বেলা ৩টা পর্যন্ত।
সভায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেন, আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ চাই। সরকার যদি অপসারণ না করে, কীভাবে অপসারণ করতে হবে, সেই হাতিয়ার আমাদের জানা আছে। বিসিএস পরিবারকে বাঁচানোর জন্য হয়তো আরও কষ্ট করতে হবে উল্লেখ করে আব্দুস সাত্তার ৪ জানুয়ারি মহাসমাবেশ করার প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে তিনি সহকারী কমিশনার (শুরুর পদ) থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত পদগুলোর সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান।
প্রতিবাদ সভায় আরও একাধিক কর্মকর্তা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের পদত্যাগ দাবি করে কমিশন পুনর্গঠনের আহ্বান জানান। বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সোহেল রানা সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ইতিহাস ও নানা তথ্য তুলে ধরেন। একই সঙ্গে উপসচিবের পদটি শুধু যে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য হওয়া উচিত, এর পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। উপসচিব পদ নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এটি বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক।
ঢাকার ডিসি তানভীর আহমেদ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেওয়ার এখতিয়ার, থানা পরিদর্শনের ক্ষমতা এবং মামলা দায়েরের সময় চার্জশিট দেখার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রশাসনকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। এখন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) চেয়ে এসপি ক্ষমতাধর, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) চেয়ে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) বেশি ক্ষমতাধর। তারা ডিসিকে সব ধরনের ফৌজদারি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সব ধরনের ফৌজদারি ক্ষমতা, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা জেলা প্রশাসককে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।
বিশেষভাবে আমন্ত্রিত সম্মানিত আলোচক হিসাবে যুগান্তরের উপসম্পাদক বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, দলবাজ প্রশাসন আর দেখতে চাই না। আপনারা আজ এখান থেকে শপথ নেন, আর কারও দলদাসে পরিণত হবেন না। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদেরও নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে কমিটমেন্ট করতে হবে যে-প্রশাসনের মধ্যে নিজের লোক আর খুঁজবেন না। আমরা মেধাভিত্তিক, পেশাদার ও সাহসী প্রশাসন দেখতে চাই। তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের হারানো সব ঐতিহ্য ও এখতিয়ার ফিরিয়ে আনতে হবে। কোথাও কোনো কোটা থাকতে পারবে না। যারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রশাসন ক্যাডারের পদ নিয়ে নতুন করে টানাটানি করছেন, তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসাবে নতুন যাত্রা শুরু করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে। চলতি মাসে তাদের সংস্কারের সুপারিশ চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
কঠোর কর্মসূচির হুমকি ও ছয় দফা : বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ কঠোর কর্মসূচির হুমকি এবং নিজেদের ছয় দফা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমরা এক আছি, এক থাকব। দ্বিতীয়ত, আমরা প্রশাসন ক্যাডারের ওপর কোনো ধরনের সার্জারি বা কোটা আরোপ করতে দেব না। তৃতীয়ত, কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। চতুর্থ, প্রশাসনে কোনো পর্যায়ে অন্ধভাবে বহিরাগত কাউকে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পঞ্চম, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সব ধরনের কর্মকর্তাকে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠ, দেশকে কোনোভাবে অস্থিতিশীল করার যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য প্রশাসন সারা দেশে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করবে। এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা তাতে সম্মতি দেন।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সভায় আরও বক্তব্য দেন প্রশাসনের ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন আলমগীর, ১৯৭৯ ব্যাচের এসএম জহিরুল ইসলাম, ১৯৮১ ব্যাচের হেলালুজ্জামান, ১৯৮৪ ব্যাচের এমএ খালেক, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ, আবু ইউসুফ, ১৯৮৫ ব্যাচের মোহাম্মদ মসিউর রহমান, ১৯৮৬ ব্যাচের মো. জাকির হোসেন কামাল, শামীম আল মামুন, ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ, উপসচিব নূরুল করিম ভুঁইয়া, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সারওয়ার আলম, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সামিউল মাসুদ, ২৮ ব্যাচের খন্দকার মুশফিক রহমান, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. বদরুদ্দোজা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম এবং ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী।
এদিকে আজ বিআইজিএম-এ বিএএসএ-এর সঙ্গে বৈঠকে বসছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বিএএসএ সভাপতি, মহাসচিব এবং ঢাকার ডিসি এ বৈঠকে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মানববন্ধন আজ : প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা সংস্কার কমিশনের খসড়া সুপারিশ সমর্থন করে তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আজ তারা বেলা ১১টা থেকে ১২টা দেশব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। এছাড়া ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন। তাদের দাবির সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটি উপসচিব পদে ৫০:৫০ আনুপাতিক হারে পদোন্নতির দেওয়া বিধান প্রবর্তনের জন্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনুরোধ করেন।