১৫ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চাইলেন ট্রাইব্যুনাল
ওবায়দুল কাদের দেশ ছাড়লেন কীভাবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় ২ মাস বাড়িয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৫ জনের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়ও ২ মাস বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরও ওবায়দুল কাদের কীভাবে দেশ ছেড়ে গেলেন তা জানতে চেয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর আগে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১ মাস সময় দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। মঙ্গলবার সেই প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। তবে তা দাখিল করতে পারেনি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। এর আগেও মামলা দুটির তদন্ত প্রতিবেদন জমার ২ মাস করে সময় চেয়েছিলেন চিফ প্রসিকিউটর। তখন ১ মাস করে সময় মঞ্জুর করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত এসেছে। এসব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আরও ২ মাস সময় প্রয়োজন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি এবং ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আলাদাভাবে ২ মাস করে সময় চান চিফ প্রসিকিউটর। দুটি আবেদনই মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ ধার্য করা হয়েছে। শুনানিকালে গাজী মোনাওয়ার হুসাইন, বিএম সুলতান মাহমুদ, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ট্রাইব্যুনালের অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ৩ মাস দেশে ছিলেন কাদের : এদিকে শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ওবায়দুল কাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ৩ মাস বাংলাদেশে ছিলেন। এরপরও তিনি কোথায়-কীভাবে ছিলেন এবং কেন তাকে গ্রেফতার করা হয়নি, তিনি কীভাবে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করেছেন-এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই ব্যাখ্যা যেন দেওয়া হয় সে ব্যাপারে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি জাতীয় ট্রাইব্যুনাল। এটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনালের আদেশ-নির্দেশ যদি কোনো সংস্থা বা বাহিনী না মানে তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা রাষ্ট্রের কাজে সহযোগিতা করছে না এবং আইন অনুযায়ী কাজ করছে না।
তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম অবস্থায় তাদের শুধু এটুকু বলব, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মানতে হবে। এটা আপনার আইনগত দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের প্রতি আপনার আনুগত্যের প্রশ্ন। যদি কেউ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরও কোনো আসামিকে পালাতে সহযোগিতা করে তাহলে ধরে নিতে হবে তারা আইন অনুযায়ী কাজ করছে না। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আমরা এখনই সেদিকে যাব না। সবার প্রতি আহ্বান জানাব, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য নয় বরং আপনারা আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আপনাদের আনুগত্য দেখাবেন।
অপরাধের নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনা : তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা আজকে অপরাধের নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনার মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতের কাছে উপস্থাপন করেছি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বাইরেও গত ১৬ বছর ধরে দেশের হাজার হাজার মানুষকে শেখ হাসিনার নির্দেশে ও তার পরিকল্পনায়, গোপন কারাগারে নিষ্ঠুরতম পন্থায় বছরের পর বছর আটক রেখে নির্যাতন, হত্যা করা ও তাদের লাশকে সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে বিভিন্ন নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সে বিষয়ে বর্তমান সরকারের গঠিত গুম কমিশনের কাছে যে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন আছে, তার কিছু অংশ যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব অপরাধের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পৃক্ত ছিলেন বলে গুম কমিশন খুঁজে পেয়েছে। মানুষকে গুম করার পর কোথায় রাখা হয়, গুম কমিশন সেসব স্থান ভিকটিমদের মাধ্যমে সশরীরে শনাক্ত করেছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, গুম কমিশনের এই তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা যেসব অপরাধ পেয়েছি তা ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়েছেন। একই সঙ্গে আমরাও এ বিষয়ে রিপোর্ট দেব। একসঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও গুমসংক্রান্ত যে অপরাধ সেগুলোকে মিলিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত। আমরা ২ মাস সময় চেয়েছি। আদালত ১৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করব এ সময়ের মধ্যে পুরো তদন্ত প্রতিবেদন বা এর অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে। এ বিষয়ে আমরা দিন-রাত চেষ্টা করব।
ট্রাইব্যুনালে আনা হয় যাদের : মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে আনা হয়েছিল সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এই ১৬ জনসহ এ মামলার আসামি ৪৫ জন।
আমরা বোবা, আপনারা মুক্ত আছেন তো-পলক : মামলার শুনানি শেষে দুপুর ১টার দিকে এই ১৬ জনকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশে একে একে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। এ সময় সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রিজন ভ্যানের ভেন্টিলেটর থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে জানতে চান, ‘আপনারা ভালো আছেন? আপনারা ভালো থাকলেই ভালো।’ গণমাধ্যমকর্মীরা জবাবে বলেন, ‘আমরা ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন তো?’ তখন পলক বলেন, ‘ভাই, বোবা হয়ে আছি, বোবা। আপনারা মুক্ত আছেন তো?’