বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া
সুস্পষ্ট রোডম্যাপের প্রত্যাশা
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন, যা ইতিবাচক হিসাবে দেখছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো। তবে নেতাদের অভিমত-সেখানে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে ‘যদি’ বলেছেন, সেটা তারা আশা করেননি। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মাস বা সময়সীমা উল্লেখ করলে ভালো হতো। প্রধান উপদেষ্টা অল্পদিনের মধ্যেই সংস্কার ও নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট করে একটি রোডম্যাপ দেবেন বলে আশা করছেন দলগুলোর নেতারা।
তারা আরও মনে করেন, যদি প্রধান উপদেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে পথ বের করতে বেশি সময় লাগবে না। তাতে নির্বাচন কোনোভাবেই ২০২৫ সাল অতিক্রম করার কথা না। বরং বেশ আগেই নির্বাচন করা সম্ভব। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচন নিয়ে যে কথা বলেছেন, এর ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সোমবার যুগান্তরের কাছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা এসব কথা বলেন। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি নির্বাচন নিয়ে বলেছেন, ‘আমি সব প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্পকিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়; তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষদিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সেজন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। আমরা আশা করি, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) সংস্কার ও নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট করে একটি রোডম্যাপ দেবেন।’
এর আগে রোববার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের আর কত মাস প্রয়োজন, তা জনগণের জানার অধিকার আছে। আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণার কথা শুনলেই যদি উপদেষ্টাদের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে, সেটি অবশ্যই গণ-আকাঙ্ক্ষাবিরোধী হবে। তারেক রহমান প্রশ্ন রাখেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসলে কী করতে চাইছে? সরকার জনগণের সামনে তাদের কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণা করবে, এটি একদিকে জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, অপরদিকে প্রশাসনিক কার্যক্রমেও গতিশীলতা বাড়াবে। তিনি এও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সব কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের কাছে যত স্বচ্ছ থাকবে, জনগণও সরকারের প্রতি তত সমর্থন দেবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখি, যদি তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আন্তরিকভাবে বলে থাকেন। যদিও এটা একটু বিলম্বিত ঘোষণা, জাতির প্রত্যাশা আরও একটু আগে ছিল। প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে আরও সিরিয়াসলি প্রচেষ্টা চালালে, পরিবেশ অনুকূলে থাকলে নির্বাচন আগেই করা সম্ভব হতো। তবে বিলম্বিত হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, তা বিবেচনায় নিয়ে আমরা এ ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখছি। আমরা মনে করি, নির্বাচনটা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়; তাহলে দু-এক মাস আগে-পরে নির্বাচন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে, ভোট দিতে মানুষ পারবে কি না। এটা এখন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সরকারকে অন্তরিকভাবে আগানো উচিত, সেজন্য আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন-নির্বাচন যদি করতে হয়। নির্বাচন করতে হবে, তা তিনি বলেননি। এর মানে যদি তাদের ওপর নির্বাচন করার জন্য কেউ চাপ সৃষ্টি করে, তারা যদি নির্বাচন করতে বাধ্য হন, তাহলে অল্পকিছু সংস্কার করে নির্বাচনটা হয়তো ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ করতে পারেন। এটা একটা বিষয়। আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে বলেছেন। নির্বাচন করাটা তো আপনাদের দায়িত্ব। নির্বাচন তো করতেই হবে। এক্ষেত্রে যদি, কিন্তুর প্রশ্ন নেই। নির্বাচন করতে হবে, এটাই। পাশাপাশি সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন হবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। তিনি আরও বলেন, আমাদের মধ্যে ঐকমত্য তো আছেই। নতুন করে কমিশন গঠনের বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার না। এরপরও নির্বাচনের ব্যাপারে কমপক্ষে একটি সময়সীমা ঘোষণা করেছেন, এজন্য ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, এ সময়সীমা ঠিক থাকবে। ২০২৫ সালে না হোক, ২০২৬ সালের শুরুতেই আশা করি একটি নির্বাচন পাব।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় উপদেষ্টারা নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিভিন্নরকম মন্তব্য করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। তাদের কাজ হলো নিজস্ব মন্ত্রণালয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখা, নিজস্ব মন্ত্রণালয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা। কিন্তু সেটা না করে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করছেন, সেটা সঠিক নয়। আমরা আশা করব, প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন। আমি প্রথমদিন থেকে বলে আসছি, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মপরিকল্পনা করার সুযোগ দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার অনির্দিষ্টিকালের জন্য আসেনি। এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় বছর। এর মধ্যে তাদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এর অতিরিক্ত সময় কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বিদেশিরা আস্থা রাখতে পারছেন না। যে কারণে বিনিয়োগ আসছে না। বিদেশিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলো হচ্ছে না। সুতরাং এখানে নির্বাচিত সরকার একান্তই প্রয়োজন। তাদের মূল দায়িত্ব হবে যতদূর সংস্কার না করলে দেশ সঠিক পথে আগাবে না, ওই সংস্কারগুলো করা এবং অনতিবিলম্বে নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ জনগণকে দিয়ে দেওয়া। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, বিদেশিরাও আশস্ত হবে, দেশের জনগণও আশস্ত হবে। অন্যথ্যায় তাদের লোভলালসাটাই প্রকাশ পাবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তার (প্রধান উপদেষ্টা) বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখতে চাই। তিনি নির্বাচন নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন। আমার মনে হয়, আগামী অল্পদিনের মধ্যেই তারা গোটা নির্বাচনের তৎপরতা সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেবেন। আর প্রধান উপদেষ্টার পরে কাজ হবে, নির্বাচন কমিশনকে একটি স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যাতে কমিশন নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করতে পারেন। নির্বাচনের সুস্পষ্ট ঘোষণা হলে তিনটি জিনিস দাঁড়ায়, একটা হচ্ছে মানুষের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিক প্রস্তুতির জন্য একটি পরিকল্পনা করতে পারেন। আর তৃতীয়ত হলো, গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার, সবারই সরকারের প্রতি আস্থার জায়গা বাড়তে পারে। তাই আশা করব, অল্পদিনের মধ্যেই আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করে তারা পুরো বিষয় দেশবাসীর সামনে হাজির করবেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা অনেকদিন একটা সময়সীমার কথা বলছিলাম, সেটি প্রধান উপদেষ্টা অন্ততপক্ষে দিয়েছেন, সেজন্য ধন্যবাদ জানাই। যদিও তিনি নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ বলেছেন; সেটা আমরা আশা করিনি। এক্ষেত্রে তিনি সুনির্দিষ্ট মাস বা সময়সীমা উল্লেখ করলে ভালো হতো। তিনি সংস্কার নিয়ে অল্প সংস্কার ও বড় সংস্কারের কথা বলেছেন। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করার দরকার, ততটুকু করে দ্রুত নির্বাচন দিন। আমার মনে হয়, যদি তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেন, আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই পথ বের করতে বেশি সময় লাগবে না। তাতে নির্বাচন কোনোভাবেই ২০২৫ সাল অতিক্রম করার কথা না। বরং বেশ আগেই নির্বাচন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তাদের কী কী কাজ আছে, সেই কাজগুলো শেষ করতে পারলে বলা যাবে। যেমন ভোটার লিস্টের কথা বলেছেন, প্রায় নয় মাস লাগবে। তারপর সংস্কারের সবগুলো যে রিপোর্ট দেবে, তারা একটা জাতীয় সমন্বয় কমিটির মতো করবে। তারা সবার সঙ্গে কথা বলে একটা জাতীয় ঐকমত্যের চেষ্টা করবে। এর ভিত্তিতে সংস্কার করবে। এটা এমন নয় যে এখনই করতে হবে। এটা একসময় সুনির্দিষ্ট করতেই হবে। কিন্তু এখন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) তার ধারণাগুলো বলেছেন। তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, সেই কাজগুলো করেই নির্বাচন দিতে চান। আর আমরাও তো একটা নয়-ছয় মার্কা নির্বাচনের কথা বলছি না। যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যে নির্বাচনের ফলের ওপর ভিত্তি করে আমরা গণতন্ত্রের পরবর্তী ভিত নির্মাণ করতে পারব, সেটার জন্য একটু ক্যালকুলেটিভ যাওয়াই ভালো।
তিনি বলেন, সরকারের এই চার মাসের পারফরম্যান্সকে কীভাবে ধীরগতি বলব। গুম কমিশনের রিপোর্ট দেওয়া, দুর্নীতির রিপোর্ট দেওয়া-এতে খানিকটা ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) দিয়েছেন। এটা বিবেচনায় রেখে বড় দাগে সংশয় প্রকাশ করছি না। আমি মনে করি, যদি সামনের বছরের শেষে বা পরের বছরের প্রথমে ভোট হয়, সেটা ভালো। সেটা তিন মাস বা ছয় মাস, এদিক-ওদিক হলে বিরাট কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা একটা ধারণা পেলাম নির্বাচনের। কিন্তু আমরা মনে করি, সংস্কার কমিটিগুলোর রিপোর্ট পেশ করার পরই সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার। নির্বাচনটা আগামী বছরের জুনের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া শ্রেয়।
এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, প্রথম কথা হলো দীর্ঘদিনের একটা প্রত্যাশা ছিল-একটা টাইম ফ্রেম দেবেন। এখন একটা টাইম ফ্রেম দিয়েছেন। আমরা আশা করি, এটার আরও বিস্তারিত বলবেন। আরও ব্যাখ্যা ওনারা দেবেন। আমরা মনে করি, যে দূরত্বগুলো তৈরি হচ্ছে, ধীরে ধীরে ওনারা তা দূর করবেন।