শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত
নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্মরণ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যথাযোগ্য মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সারা দেশে পালিত হয়েছে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে হত্যার দিনটি ঘৃণাভরে স্মরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ-সেখানে শোষণহীন ও সমৃদ্ধশালী এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন দেশের মানুষ।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং রায়েরবাজার শহিদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমি-স্মৃতিসৌধে শনিবার দিনভর হাজারো মানুষের আনাগোনায় পূর্ণ ছিল। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
দিবসটি উপলক্ষ্যে এদিন ভোরে রাজধানীর মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সকাল ৭টায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং পরে প্রধান উপদেষ্টা সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকশ দল রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢল নামতে শুরু করে সাধারণ মানুষের। বিভিন্ন দলীয় ও সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে দলবদ্ধভাবে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সর্বস্তরের মানুষ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে। এ সময় শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করছেন অনেকে।
সরেজমিন শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সি হাজারো মানুষের ঢল। অনেকে এসেছেন শিশুদের নিয়ে। তবে শহিদ বেদির আশপাশে বিশৃঙ্খলাও দেখা গেছে। যে যার মতো করে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই বিশৃঙ্খলভাবে শহিদ বেদিতে অবস্থান নিয়েছিলেন।
এদিকে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি-স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। শনিবার প্রথম প্রহরে এই শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মোহাম্মদপুর থানা ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সাধারণ মানুষ। বিএনপি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী দল শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আজকের এইদিনে জাতির সূর্যসন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি। এ দিবসগুলো আমাদের মূল পরিচয়ের স্মারক। আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থান এ বছর আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এ জাতি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফ সোহেল বলেন, ৭১ ও ২৪ নিয়ে একটি মহল জল ঘোলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্টের দোসররা বারবার দেখানোর চেষ্টা করছে, আমরা তরুণ প্রজন্ম যারা রক্ত দিয়ে নতুন বাংলাদেশকে নিয়ে এসেছি, তারা ৭১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা ২৪-কে মনে করি ৭১-এর ধারাবাহিকতা।
মিরপুর ও রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম। এ সময় তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক ইতিহাস উপেক্ষা করা হয়েছে। ইতিহাস তো আর বদলানো যাবে না। কিন্তু ইতিহাসে যে ভুয়া তথ্য দেওয়া আছে সেটা বদলানো উচিত। যদি আমরা সবাই বস্তুনিষ্ঠভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই, আমরা যদি সামনে এগিয়ে আসি তাহলে অবশ্যই সম্ভব হবে।
যে বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শহিদ বুদ্ধিজীবীরা আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই দেশ গঠনের লড়াই অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে গান, আবৃত্তি, নাচ, আলোচনার মাধ্যমে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করেছে উদীচী। শনিবার বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আয়োজন করা হয় এই স্মরণ অনুষ্ঠান। এতে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। আলোচনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।
সকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীর রেজাউল আলম, ঢাকা মহানগর কমিটির জোনায়েদ হোসেন, বাবর চৌধুরী, মোহাম্মদ ডালিম, আরিফুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা জানিয়ে সাইফুল হক বলেন, গত ৫৪ বছরে সবাই শহিদদের বন্দনা করেছে, কিন্তু কেউই শহিদদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করেনি। শহিদ বুদ্ধিজীবীরা যে সাম্যভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বিপরীতে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।