রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণখেলাপি
নবায়নে কঠোর সরকার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
খেলাপি ঋণ নবায়ন বা পুনঃতফশিলের ক্ষেত্রে আর ছাড় দেওয়া হবে না। গত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ব্যক্তিবিশেষ বিবেচনায় যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মেয়াদ নতুন করে বাড়ানো হবে না। পর্যায়ক্রমে আগে দেওয়া ছাড়ের নীতিমালাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। খেলাপি ঋণ নবায়ন প্রক্রিয়াকে ফিরিয়ে আনা হবে স্বাভাবিক ধারায়। খেলাপিদের ছাড় দিতে গিয়ে যেসব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত পরিস্থিতির কারণে কোনো ঋণ খেলাপি হলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বার্থে সবার জন্য একই ধরনের ছাড়ের নীতি প্রয়োজনবোধে গ্রহণ করা হবে। ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসাবে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ নবায়নে চলেছে ছাড়ের ছড়াছড়ি। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ যেমন বেড়েছে, তেমনই খেলাপি ঋণ নবায়নে একের পর এক ছাড়ও বেড়েছে। প্রথমে নীতিমালা শিথিল করে খেলাপি ঋণ নবায়নে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পরে বড় গ্রুপ বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য ছাড়ের নীতিমালা করা হয়। এতেও খেলাপিরা তৃপ্ত হয়নি। পরে ব্যাংকভেদে ও খেলাপি ব্যক্তিভেদে বিভিন্নরকম ছাড় দেওয়া হয়েছে। এগুলো কোনো নীতিমালার আলোকে দেওয়া হয়নি। আইনকানুন বা বিধিবিধানের কোনো তোয়াক্কা না করে অনেকটা ব্যক্তিবিশেষের চাহিদামতো খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এমনকি বছরের পর বছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ না হলেও তা খেলাপি না করে নিয়মিত রাখা হয়েছে। বিশেষ কিছু গ্রুপের কাছ থেকে ব্যাংক কোনো ঋণ আদায় করতে পারেনি। উলটো তাদেরকে নিয়মিত নতুন ঋণ দিয়ে বা ঋণসীমা বাড়িয়ে ঋণকে খেলাপিমুক্ত রেখেছে।
২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে খেলাপিদের ছাড় দেয়। ওই সময়ে ঋণ খেলাপি হওয়ার মেয়াদ তিন মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পরই খেলাপি হয়। বাংলাদেশেও তাই ছিল। ২০০৯ সালে তা তিন মাস বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়। অর্থাৎ ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস পর খেলাপি হবে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থি। খেলাপি ঋণের প্রচলিত সংজ্ঞার বিষয়ে ওই সময়ে আইএমএফ আপত্তি করলে তা আংশিক সংশোধন করা হয়। বাকিটা পরবর্তী সময়ে করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দীর্ঘ সময় আন্দোলন করে। এতে অনেক উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ওই ক্ষতি মোকাবিলা করতে ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা। বিশেষ ছাড়ে খেলাপিরা ঋণ নবায়নের সুযোগ পান। এ সময় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়।
বেক্সিমকো, এস আলমসহ সরকারের ঘনিষ্ঠ বড় কয়েকটি গ্রুপের ঋণ বেড়ে বড় অঙ্কের সীমা অতিক্রম করলে ব্যাংক থেকে তাদের নতুন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ে। কারণ, ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো গ্রুপ বা কোম্পানিকে দিতে পারে না। এ কারণে ওই সময়ে এ নীতিমালা শিথিল করে বিভিন্ন খাতে কতিপয় উদ্যোক্তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড় দিয়েছে।
বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২০১৮ সালেও খেলাপি ঋণ নবায়নের বিশেষ ছাড় দেওয়া হয় বড় উদ্যোক্তাদের জন্য। ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ছাড়ের নজির। ওই সময়ে কিস্তির ২ শতাংশ অর্থ নগদ পরিশোধ করে দীর্ঘ সময়ের জন্য খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এ সুবিধার আওতায় বড় উদ্যোক্তারা খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছেন। এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হলেও পরে তা গত সরকারের পুরো সময় গ্রুপ বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য চালু ছিল। ২০১৮ সালে দেওয়া ছাড়ের সুবিধা নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় বা ছাড়ে ২০১৯ সালে ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়।
২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও সুদ মওকুফের জন্য ছাড় দেয়। ওই সুবিধা চালু থাকা অবস্থায়ই ২০২২ সালের মার্চ থেকে শুরু বৈশ্বিক মন্দা। এর প্রভাব মোকাবিলার জন্যও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিস্তির এককালীন নগদ অর্থ পরিশোধ ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। এসব সুবিধায় ২০২০ সালে নবায়ন করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। ২০২১ সালে তা বেড়ে ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়।
২০২২ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসাবে নিয়োগ পান আব্দুর রউফ তালুকদার। এসেই তিনি প্রথম যে সার্কুলারটি করেন তাতে ঋণখেলাপিদের আরও বড় ছাড় দেওয়া হয়। নতুন নীতিমালায় কিস্তির আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফশিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে যেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ছিল। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালকরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃতফশিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃতফশিলের ক্ষেত্রে পর্ষদ প্রস্তাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে চূড়ান্ত করত। ওই নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী পর্ষদ অনুমোদন করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শুধু অবহিত করবে। ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। যেটি এখন ধরা পড়ছে।
ওই সময়ে খেলাপি ঋণ নবায়নের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। মূলত দুই জন শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপকে ওই সুবিধা দেওয়ার জন্য আলোচ্য নীতিমালাটি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি এখনো বহাল রয়েছে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় একসঙ্গে সব বিষয় করা হবে।
সূত্র জানায়, ছাড় দেওয়া ওখানেই শেষ হয়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে আরও একদফা ছাড় দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। এতে কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান নতুন ঋণ নিতে পারবে। এতে ঋণখেলাপি কোম্পানির নতুন ঋণ পাওয়ার দরজা আরও খুলে যায়। আগে কোনো গ্রুপের একটি কোম্পানি খেলাপি হলে অন্য কোম্পানি নতুন ঋণ পেত না। এ সুবিধা দেওয়ার ফলে খেলাপিদের আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, অসাধু উদ্যোক্তারা এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে খেলাপি হলে ওই কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে নতুন কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পায়। আগে এ পদ্ধতিতে খেলাপিরা ব্যবসা করত গোপনে। ওই নীতিমালার ফলে তা প্রকাশ্যেই করতে পারবে। এসব ছাড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলে দিতে চাচ্ছে।
ছাড়গুলোর আওতায় ২০২৩ সালে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি নবায়ন করা হয়।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল-পাঁচ বছরে ২ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বিশে ছাড়ে বড় গ্রুপ বা কোম্পানির ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে বিশেষ ছাড়ে আরও ঋণ নবায়ন করা হয়েছে, সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে নেই। বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা খেলাপি ঋণের কিস্তি গ্রাহক নিয়মিত পরিশোধ না করায় আবার সেগুলোর একটি খেলাপি হয়ে পড়ছে। এমন ১৯ থেকে ২২ শতাংশ ঋণ খেলাপি হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে আইএমএফ মিশন। তারা ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নবায়নে ছাড় বন্ধ করতে বলেছে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ও পুনঃতফশিলের বিধান আরও কঠোর করতে বলেছে।
আইএমএফ-এর মূল্যায়ন : ২০১৯ সালে আইএমএফ বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে একটি দীর্ঘ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শেকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, উপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী-এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রহীতা। তাদের খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তারা।’ ওই সময়ে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরিস্থিতি বদলানোর। কিন্তু বদলায়নি। উলটো প্রভাবশালীদের প্রতাপ আরও বেড়েছে।