Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ব্যয়ের ১৩৫৫২ কোটি টাকাই গচ্চার শঙ্কা

সমুদ্রবন্দরের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে পায়রা

কাজী জেবেল

কাজী জেবেল

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমুদ্রবন্দরের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে পায়রা

সমুদ্রবন্দরের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে পায়রা বন্দর। নাব্য সংকটে মালবাহী সমুদ্রগামী বিদেশি বড় জাহাজ এ বন্দরে ভিড়তে পারছে না। সমুদ্র উপকূল থেকে এ বন্দরে যাতায়াতের একমাত্র নৌপথ রাবনাবাদ চ্যানেলের অনেক স্থানের গভীরতা কমতে কমতে বর্তমানে মাত্র ৫ দশমিক ৪ মিটার বা ১৮ ফুটে দাঁড়িয়েছে। এতে জোয়ারের সময়ে মাত্র ১৪-১৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লাবাহী বিদেশি জাহাজ চলাচল করতে পারছে।

অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক নদীবন্দরে যাতায়াতের নৌপথে এর চেয়ে বেশি গভীরতা রয়েছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা সম্প্রতি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সর্বনিম্ন গভীরতার এই তথ্য জানান। পলি জমে জমে গভীরতা আরও কমার আশঙ্কাও করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, সমুদ্রবন্দরে সাধারণত কমবেশি ৪০ হাজার মেট্রিক টন নদীবন্দরে যাতায়াত করে। ওই বিবেচনায় সমুদ্রবন্দর হিসাবে কার্যকারিতা হারাচ্ছে পায়রা। যদিও ড্রেজিংয়ে এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। পায়রা সমুদ্রবন্দর ও নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আরও জানা গেছে, পায়রা সমুদ্রবন্দরের ভৌগোলিকগত অবস্থান, অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির সংকট, প্রশাসনিক কার্যক্রমে দুর্বলতা, প্রশস্ত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা নির্মাণে ব্যর্থ হওয়া, এনবিআরের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ বন্দরে বিদেশি জাহাজ আসার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধু বন্দরের পাশে গড়ে ওঠা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা ও যন্ত্রপাতি বহনকারী কিছু জাহাজ আসছে। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের গত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৪৯৫টি বিদেশি জাহাজ এসেছে। চলতি বছরে মাত্র ১০৭টি বিদেশি জাহাজ এসেছে। এতে ৪১ লাখ ২০ হাজার ২০৬ টন পণ্য পরিবহণ করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পায়রা সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও ড্রেজিংয়ের পেছনে এ পর্যন্ত সরকার ১৩ হাজার ৫৫২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে, তাতে ব্যয় মোট ধরা আছে ১৬ হাজার ১৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ড্রেজিং ও ড্রেজার ক্রয়ের জন্য সম্প্রতি ৪৮১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ের আরেকটি প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। অথচ মোট অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের বিপরীতে চালুর পর থেকে গত ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করেছে ভ্যাটসহ মাত্র ৩৯৩ কোটি ৮২ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এ বন্দরে ব্যয় হওয়া এ বিনিয়োগ আদৌ উঠে আসবে কি না-তা নিয়ে সন্দিহান নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও পায়রা বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ কারণে নতুন করে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহ কম অন্তর্বর্তী সরকারের।

জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে ভুল জায়গায় পায়রা বন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিপুল বিনিয়োগও করা হয়েছে। সমুদ্র থেকে ৭৫ কিলোমিটার ভেতরে টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এত বড় চ্যানেলে নাব্য ধরে রাখা এক প্রকার অসম্ভব। নাব্য ধরে রাখতে হলে যে পরিমাণ টাকার দরকার হবে, সেই টাকা আদৌ উঠে আসবে কি না-আমরা সন্দিহান। তিনি বলেন, এ বন্দরের কতটা লাভজনক হবে তা নিরীক্ষায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ করার চিন্তা করছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা-এই তিনটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে সোনাদিয়ার উপযোগী স্থান হিসাবে চিহ্নিত হলেও ভূরাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা বন্দর নির্মাণ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশের নির্মাণ করা এটিই একমাত্র বন্দর। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন পাশ করে তৎকালীন সরকার। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর এ বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন এটিকে ‘গভীর সমুদ্রবন্দর’ এবং ‘অর্থনৈতিক হাব’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সময়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে সরে শুধু সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

ড্রেজিংয়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় তবুও নাব্য সংকট : জানা গেছে, সমুদ্র থেকে ৭৫ কিলোমিটার ভেতরে রাবনাবাদ চ্যানেল হয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দরে জাহাজ যাতায়াত করতে হয়। সমুদ্রবন্দরের মূল প্রাণ হচ্ছে এই চ্যানেল। এই চ্যানেলে নাব্য কমে ৫.৪ মিটারে নেমেছে। গত ১৯ নভেম্বর নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পায়রা বন্দরের সদস্য (মেরিন ও হারবার) ক্যাপ্টেন জাহিদ নাব্য সংকটের এ তথ্য জানান। পায়রা বন্দর সূত্র গত কয়েকদিনের তথ্য তুলে ধরে জানায়, ৭৫ কিলোমিটার চ্যানেলের কয়েকটি স্থানে সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৪ মিটার নাব্য রয়েছে। বাকি পথে নাব্য আরও বেশি। যদিও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ৬ মিটার গভীরতার জাহাজ চলাচল করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। নাব্য কমে যাওয়ায় ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টন কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারে। অথচ গত এপ্রিল মাসে এ চ্যানেলের গভীরতা সাড়ে ১০ মিটার ছিল বলে দাবি করেছিল পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। আট মাসেই নাব্য কমে প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, রাবনাবাদ চ্যানেলটি অতিরিক্ত পলিপ্রবণ এলাকা। গত ২৬ ও ২৭ মে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের ফলে এ চ্যানেলে আড়াই লাখ ঘনমিটার পলিমিশ্রিত কাদা ও বালি জমেছে। এছাড়া নিয়মিত পলি জমছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি জান ডে নুল নিজ দেশে ফেরত গেছে। পায়রা বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, সড়কে ভাঙাচোরা থাকলে গাড়ি হেলেদুলে চলতে পারে। কিন্তু নৌপথে সেই সুযোগ নেই। এক কিলোমিটার নাব্য সংকট থাকলে সেখানেই জাহাজ আটকে যাবে। কোনো জাহাজই চলাচল করতে পারে না। তারা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ চায়না বিদ্যুৎ কোম্পানির কয়লা নিয়ে ‘এমভি প্যাক এলকর’ নামের একটি জাহাজ ঘাটে রয়েছে। নাব্য সংকট থাকায় সমুদ্রে থাকাবস্থায় ওই জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে কয়লা নামিয়ে হালকা করা হয়। জাহাজের ওজন কমানোর পর ওই জাহাজ ঘাটে ভেড়ানো হয়েছে। ওজন কম থাকায় কম গভীরতায় প্রবেশ করতে পারছে। এতে ওই বিদ্যুৎ কোম্পানির খরচ বেড়েছে। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে দেশবাসী সুফল পায়নি-এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শফিকুল আলম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের টার্মিনাল, সংযোগ সড়ক ও সেতু নির্মাণ করার পর ড্রেজিং করার নিয়ম। কিন্তু এখানে উলটো হয়েছে। প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। সড়ক ও সেতু নির্মাণ হয়নি। অথচ এর আগেই ড্রেজিং করা হয়েছে। ওই ড্রেজিংয়ের সুফল আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে শীতকালীন শান্ত মৌসুম হওয়ায় সাগরে বিদেশি জাহাজ থেকে দেশীয় ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করা হয়। আর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাগর উত্তাল থাকায় সেটাও সম্ভব হয় না। তখন চট্টগ্রামের কতুবদিয়ায় এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে পণ্য খালাস করা হয়। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি জাহাজ এ বন্দরে আসার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমরা আগের মতো চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কয়লা ও সরঞ্জাম এ বন্দরে নেওয়া হয়।

ব্যয় ১৬১৭৯ কোটি টাকা : জানা গেছে, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও ড্রেজিংয়ে তিনটি প্রকল্প ও একটি স্কিমে ১৬ হাজার ১৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৫২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং স্কিমের ব্যয় ধরা আছে ৬৮৭৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬১০৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্পে ৪৫১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ধরা আছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩২২৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধাদি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ৪৩৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৮০৩ কোটি টাকা। এছাড়া ৪১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকার একটি ড্রেজিং প্রকল্প শেষ করেছে এ বন্দর কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাবনাবাদ চ্যানেল ড্রেজিংয়েই সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা টেন্ডার ছাড়াই খরচ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রথমে এক প্রকল্পের আওতায় ৪১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হয়। এক্ষেত্রে উলটো কাজ হয়েছে। পরে স্কিমের আওতায় টেন্ডার ছাড়াই ৫ হাজার ৬২৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা চুক্তিতে প্রথমে ক্যাপিটাল ও পরে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে বেলজিয়ামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জান ডে নুল নামক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। ওই ক্যাপিটাল ড্রেজিং ১৪ মাসে করার কথা থাকলেও সময়সীমা কমিয়ে ৮ মাসে শেষ করা হয়। অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের সময় ছয় মাস বাড়ানো হয়। এতে ড্রেজিংয়ের ব্যয়ও আরও বেড়ে যায়। পুরো টাকাই বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। রিজার্ভ থেকে এ টাকা ব্যয় করা হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড্রেজিংয়ের নতুন চুক্তি না হওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ছেড়ে নিজ দেশে চলে গেছে। সম্প্রতি ৪৮১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এ বন্দরে বিপুল টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে। নাব্য সংকট থাকলে বন্দরে জাহাজ আসতে পারবে না। বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যাবে না। তাই চ্যানেল ড্রেজিং ও হপার ড্রেজার কেনার জন্য নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করেছি। নিজস্ব ড্রেজার পাওয়া গেলে ড্রেজিং খরচ কমে আসবে। তবে এ বন্দর লাভজনক হবে কি না- তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম