সেমিনারে ফাওজুল কবির খান
জ্বালানি খাতে বিনা টেন্ডারে আর ব্যবসা নয়

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এতদিন কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। পরিচয় থাকলেই গ্যাস উৎপাদন বা পাওয়ার প্ল্যান্ট করা যেত। কিন্তু এখন থেকে বিনা টেন্ডারে এই খাতে কোনো ব্যবসা হবে না। শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) কার্যালয়ে সেমিনারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এসব কথা বলেন। তার মতে, এবার তেল আমদানিতে সরকারের ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। জ্বালানি খাতে বছরে ভর্তুকি ৫২ হাজার কোটি, মাথা পিছু ভর্তুকি তিন হাজার টাকা। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ১৫ বছরের কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা কমাতে নিজস্ব উৎস ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয় অনুষ্ঠানে।
জ্বালানির দাম ও সরবরাহ নিয়ে ডিসিসিআই এই সেমিনারের আয়োজন করে। ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম ও ড. ইজাজ হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, এবার তেল আমদানি উন্মুক্ত করায় ১২ জন টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন। এতে সরকারের ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি উন্মুক্ত করায় বিদেশি বড় কোম্পানিও টেন্ডারে অংশ নিচ্ছে। এলএনজি আমদানির ফলে জ্বালানিতে মাথাপিছু ভর্ভুকি তিন হাজার টাকা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এত টাকার গ্যাস আমদানির জন্য দেশীয় ব্যবসায়ীরা কি অনুশোচনা করবেন, না ক্ষতিপূরণ দেবেন? এ সময় ভোলার গ্যাস একটি কোম্পানিকে দেওয়ার কারণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। ফাওজুল কবির খান বলেন, গ্রাহকরা গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৫৫ টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু সরকারকে কিনতে হয় ১২-২৫ টাকায়। এলএনজি আমদানিতে ৭০ টাকা খরচ পড়লেও, শিল্প খাতে ৩০ টাকা হারে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাকি টাকা সরকার ভর্তুকি দেয়। তিনি বলেন, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। আর দেশের মানুষের মাথাপিছু ভর্তুকি প্রায় তিন হাজার টাকা। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, এখানে প্রতিযোগিতা নেই। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে অধিক মূল্যে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে আমাদের চার হাজার এমএমসিএফটি গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের আছে তিন হাজারের কম। ফলে ঘাটতি মেটাতে নিজের গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি। বিদ্যুৎ খাতে আইপিপির পরিবর্তে মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবস্থা চালু হবে। পর্যায়ক্রমে ৪০টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। এ ছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ১৫ বছরের কর অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ খাতে অর্থায়নের জন্য বন্ধকি ঋণের পরিবর্তে সম্পদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা প্রচলনে গুরুত্ব দিতে ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানান।
বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম বলেন, আগামী কয়েক বছরে কিছু প্ল্যান্টের মেয়াদ বা চুক্তি শেষ হবে। তাই নির্মাণাধীন প্ল্যান্টগুলোর কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায় ২০৩০ সালের দিকে আবারও ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ম. তামিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ ব্যবহারিক হবে না। এক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা অধিক কার্যকর হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের জন্য গৃহস্থালির ছাদ ব্যবহার করা প্রয়োজন। বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, ডলারের দাম বাড়তে থাকলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে। জমিতে কৃষির চেয়ে সোলার উৎপাদন লাভজনক। ঢাবি অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, আমাদের জ্বালানি আমদানির আগ্রহ বেশি। অথচ দেশের গ্যাস উৎপাদনে আগ্রহ কম। এ সময় দেশের সবখানে গ্যাস খুঁজতে হবে বলেও জানান তিনি।
ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর থেকে শিল্প ও সেবাখাত নির্ভর হয়ে উঠছে। তাই এখন জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও সহনীয় মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে আমাদের জ্বালানির ব্যবহার প্রায় চার গুণ বেড়েছে। শিল্পে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানির কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশীয় মজুদকৃত কয়লা উত্তোলনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর পরও কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া উচিত। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভূমি বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রয়োজনীয় জমির অপ্রতুলতায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। তার মতে, দেশের কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ পুরোনো। ২০৩০ সাল নাগাদ এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা উল্লেখজনক হারে কমবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি জ্বালানি আমদানিতে বিদ্যমান সরকারি ক্রয় নীতিমালা সংশোধন করে মূল্য স্থিতিশীল রক্ষার কৌশলও নিতে হবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউঅ্যাবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. নূরুল আক্তার, আইএফডিএল বাংলাদেশ’র পার্টনার ব্যারিস্টার শাহওয়ার জামাল নিজাম এবং বিএসআরএমের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সৌমিত্র কুমার মুৎসুদ্দি।