নতুন ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
মানুষের আস্থা অর্জনই মূল চ্যালেঞ্জ
অবাধ নির্বাচনে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে প্রত্যাশা বিএনপির * সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে জাতির আস্থার প্রমাণ দেবে আশা জামায়াতের * অতীতের অবস্থা ফিরে আসুক জনগণ তা চায় না : ইসলামী আন্দোলন
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নেতাদের মতে কমিশনকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে হবে। এগুলোই মূলত নতুন কমিশনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে দলগুলো। তাদের মতে গত সরকারের গঠিত কমিশনগুলো মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন দলীয় অনুগত কমিশনে পরিণত হয়েছিল। তাদের প্রতি কারও আস্থা ছিল না। নতুন কমিশন সততা, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সবার আস্থা অর্জন করবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন নেতারা। তারা বলছেন, গত একাধিক কমিশন জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার পরিবর্তে নির্বাচন নিয়ে তামাশা করেছিল। অতীতের অবস্থা ফিরে আসুক জনগণ তা চায় না। তাই আসল পরীক্ষা হবে স্বল্পতম সময়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোও সার্বিক সহযোগিতা করবে। নতুন ইসি গঠনের পর শুক্রবার বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন।
দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রবেশের বার্তা গেল জনগণের কাছে। কমিশন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি নির্বাচন দেবে, যেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে, যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দিতে পারবে। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে ইসি জাতির আস্থা অর্জন করবে বলে প্রত্যাশা জামায়াতে ইসলামীর। কমিশনকে সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, তারা (রাজনৈতিক দল) যদি নিজেরা আবার হিসাবের বাইরে কাজ করেন তবে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা কষ্টকর হবে। আর অতীতের অবস্থা ফিরে আসুক জনগণ তা চায় না বলে জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। গণতান্ত্রিক বাম জোটের প্রত্যাশা, নতুন কমিশন ভালো ব্যবস্থার উদাহরণ রেখে যাবেন, যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএমএম নাসির উদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পাঁচ সদস্যের নতুন ইসি (নির্বাচন কমিশন) গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। রোববার শপথ নেবেন তারা।
বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে ভোটের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়ে আসছিল। নতুন কমিশন গঠন নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি নির্বাচন দেবে, যেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দিতে পারবে। সব পর্যায়ে, সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করল। এখন এই বার্তা গেল জনগণের কাছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য যে প্রস্তুতি বা যে প্রক্রিয়া তার কতটুকু করতে পারে, সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। নতুন নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে জাতির প্রতি তাদের আস্থা প্রমাণ করবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশন সততা, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করবে বলে আমরা আশাবাদী। বিগত ১৬ বছর নির্বাচন কমিশন দলীয় অনুগত কমিশনে পরিণত হয়েছিল। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার পরিবর্তে নির্বাচন নিয়ে তামাশা করেছিল। অতীতের অবস্থা ফিরে আসুক জনগণ তা চায় না। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা করবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি জন আস্থা ফিরিয়ে আনা ও গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন করা। এজন্য ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা নতুন নির্বাচন কমিশনের পবিত্র দায়িত্ব। তিনি বলেন, বাস্তবে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার খোল নলচে পালটানো ছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে উঠবে না। নির্বাচন কমিশনের আসল পরীক্ষা হবে-সম্ভব স্বল্পতম সময়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা।
গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এখন যেহেতু একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে। সেই সরকার নির্বাচনে অংশ নেবে না, কারণ তাদের তো দল নেই। সেই হিসাবে নির্বাচন কমিশনের ভালো করার কথা, ভালো কিছু করার আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন ভালো মানুষ। উনি সাক্ষৎকারে অঙ্গীকারের কথা বলেছেন, যাতে ভালো নির্বাচন করতে পারেন। উনার নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন চলবে সেটা যতদূর সম্ভব ক্ষমতার মধ্যে যা থাকবে তা ভালো করার চেষ্টা করবে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে ভালো করার জন্য তো ব্যবস্থার প্রশ্ন আসে। কারণ নির্বাচন কমিশন মানে তো আর পাঁচটা কমিশন না। একদম নিম্নতর পর্যায় পর্যন্ত ভোটের পদ্ধতি, তাতে যারা যুক্ত থাকবেন তাদের সবারই আন্তরিকতা, সততার প্রশ্ন। সেটা নিয়ে খুব বড় আকারে কিছু বলার নেই। আমাদের আশাবাদী হতে হবে। কারণ ফেল করার তো কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে তাদের সহযোগিতা করে সেটার আহ্বান করছি। তারা যদি নিজেরা আবার হিসাবের বাইরে কাজ করেন, তাহলে নির্বাচন ভালোভাবে করাটা কষ্টকর হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা ভালো নির্বাচন যেমন উপহার দেবে, একই সঙ্গে ভালো নির্বাচনি ব্যবস্থার উদাহরণ রেখে যাবে, যা আগামীতে নির্বাচনকে আর প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। একটা অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও আমরা দেখছি নানা অংশ, নানা গ্রুপ তার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে হয়তো এই প্রভাব বিস্তারের কাজটা আরও চলবে। এই নির্বাচন কমিশনের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হবে কোনোভাবেই প্রভাব বিস্তারকারী শক্তির পক্ষে না থেকে সাধারণ মানুষের পক্ষে থেকে একটা ভালো নির্বাচন তারা উপহার দেওয়া। সময়ই বলে দেবে তারা প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারলেন।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, এটা নির্বাচনের দিকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি অথবা এটা নির্বাচনের অগ্রগতি বলা যেতে পারে। আশা করি তারা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন। অভিজ্ঞ ও সৎ লোকের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যক্তিগতভাবে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন করবেন।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে যারা রয়েছেন, আশা করছি তারা ভালো করবেন। দীর্ঘ বছর ধরে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আমাদের প্রত্যাশা, মানুষ যাতে স্বেচ্ছায় যার ভোট সে দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করবে। ভোট যাতে একটা আনন্দ-উৎসব পরিবেশে হয়, সেটা করবে। আশা করব নির্বাচন যাতে ২০২৫ সালের মধ্যে হয়, সেই ব্যবস্থাও করবে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন আপাত দৃষ্টিতে ভালো হয়েছে। কমিশন গঠনে সবার মতামত নেওয়ার কারণে রাজনৈতিক দল বা অংশীজনদের কারও পক্ষ থেকে তেমন কোনো আপত্তি চোখে পড়েনি। সিইসি যিনি নিযুক্ত হয়েছেন তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। প্রশাসনে তার সাফল্য ও দক্ষতার সুনাম আছে। অন্যান্য কমিশনারদের ব্যপারেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্যতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের সুনাম আছে। আশা করি এই কমিশন দ্রুত কাজ শুরু করবে এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।
ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে এই কমিশন করেছে। আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই, আমরা তাদের স্বাগত জানাই।