নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন
সিইসি সাবেক সচিব নাসির উদ্দীন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গঠন করা হলো পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন সাবেক সচিব এএমএম নাসির উদ্দীন।
নির্বাচন কমিশনার হলেন-সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্মসচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তাদের নিয়োগ দিয়েছেন।
গতকাল এ সংক্রান্ত দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন কমিশন গঠনে নাম সুপারিশ করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটি। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মধ্যে গঠিত হলো নতুন নির্বাচন কমিশন।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান। ৬ আগস্ট ভেঙে দেওয়া হয় জাতীয় সংসদ। এক মাস পর গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কমিশন। শূন্য হওয়ার আড়াই মাস পর গতকাল গঠন করা হলো নতুন কমিশন।
সিইসি হিসাবে এমন একজন ব্যক্তি নিয়োগ পেলেন, যার নাম বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সার্চ কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিল। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গ্রহণযোগ্য ও মানুষের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই কমিশনের ওপর।
নিয়োগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এএমএম নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশনের জন্য যা যা করা দরকার, আমরা তা করব ইনশাআল্লাহ। এ দায়িত্ব যখন আসছে, আমাদের সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে সবার সহযোগিতা নিয়ে।’ আন্দোলনে শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে একতরফা ভোট, ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের আমি-ডামি নির্বাচন হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
নতুন নির্বাচন কমিশন বিতর্কমুক্ত একটি নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তারা। ওই প্রত্যাশা বাস্তবায়নে নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ আছে বলেও মনে করেন তারা। নতুন সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন জানান, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো আত্মবিশ্বাস তার আছে।
গতকাল রাজধানীতে নিজ বাসায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘যার ভোট সে দেবে, এটা সম্ভব অবশ্যই হবে। আমি তথ্য, জ্বালানি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। এই তিন চ্যালেঞ্জিং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছি, ইনশাআল্লাহ এই চ্যালেঞ্জও আমি সামলে নেব। যত চ্যালেঞ্জই আসুক সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা নিয়ে ওই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ আমি জীবনে কোনোদিন ফেল করিনি। আশা করি ইনশাআল্লাহ ফেল করব না। এই আত্মবিশ্বাস আমার আছে।’
সিইসি নাসির উদ্দীন আরও বলেন, আমাদের নির্বাচনের ইতিহাস হচ্ছে কলঙ্কিত ইতিহাস। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এই নির্বাচনের জন্য মানুষ গুম, খুন-হত্যার শিকার হয়েছে। এই ভোটাধিকার আদায় করতে গিয়ে গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে কত হাজার হাজার মানুষ আহত হলো, পঙ্গু হলো। হাত, পা, চোখ হারাল। নিহত হলো কত মানুষ। তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না করতে পারি, তাহলে তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবেও সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব যাতে শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি না হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১০০তম দিনে গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছিলেন। ওইদিন তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সব দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ আরও কিছু কাজ শুরু করে দিতে পারবে, যা একটি অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সে লক্ষ্যেও সরকার কাজ করছে।
একনজরে নতুন কমিশন : দেশের চতুর্দশ সিইসি হিসাবে নিয়োগ পাওয়া নাসির উদ্দীনের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করার পর ১৯৭৭ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসাবে। দুই বছর পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। প্রশাসন ক্যাডারের এ ব্যাচটি বিসিএস ৭৯ ব্যাচ হিসাবে পরিচিত। দীর্ঘ কর্মজীবনে তথ্য সচিব, জ্বালানি সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অবসরে যান ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে।
নতুন কশিনারদের মধ্যে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম অবসরে যাওয়ার আগে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসাবে। ২০১৬ সালে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। তার আগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক যুগ্মসচিব বেগম তহমিদা আহমদ ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (আইন) হিসাবে দায়িত্ব পান। ওই বছরই তিনি প্রথমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এবং পরে পাট অধিদপ্তরের পরিচালক হন। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ১৮তম বিএমএ লং কোর্সের সেনা কর্মকর্তা হিসাবে ৩৫ বছর মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। গত সরকার ২০২০ সালে তাকে মিনিস্টার পদের কূটনৈতিক পদমর্যাদায় এ পদে নিয়োগ দেন।
যেভাবে নিয়োগ : নতুন কমিশন গঠনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ অনুযায়ী গত ৩১ অক্টোবর সার্চ কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। ছয় সদস্যের এই সার্চ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী।
সদস্য হিসাবে ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম এবং পিএসসির চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম।
আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম জমা দেয় এই কমিটি। সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত তালিকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে সার্চ কমিটি কতজনের নাম পেয়েছে এবং কোন ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।