ট্রাইব্যুনালে মামুন-জিয়াসহ আট কর্মকর্তা
এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ
পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর * গুলি করে ছাত্র হত্যা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া, গুম করা, আয়নাঘরে আটক, নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলায় সাবেক পুলিশ প্রধান এবং এনটিএমসি মহাপরিচালকসহ আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের কারাগারে রাখার নির্দেশ দিয়ে আগামী ১৯ ডিসেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ঠিক করা হয়েছে। তারা হলেন-পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল কাফি, ডিএমপির মিরপুরের সাবেক উপকমিশনার জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুর ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক এবং ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক আরাফাত হোসেন। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুটি প্রিজন ভ্যানে ওই আট কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। কিছুক্ষণ হাজতখানায় রাখার পর পৌনে ১১টার দিকে তাদের ট্রাইব্যুনালের এজলাসে নেওয়া হয়। ১১টা ২০ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ওকালতনামায় স্বাক্ষর নেওয়ার আবেদন করেন। চিফ প্রসিকিউটর এতে আপত্তি করেন। জেলখানায় গিয়ে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বাক্ষর নেওয়ার কথা বলেন তিনি। আদালত বলেন, ‘আজকের জন্য হোক। এরপর আর না। আমরাই তো বলেছি।’ পরে আইনজীবীরা আসামিদের স্বাক্ষর নেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ অন্য প্রসিকিউটররা। চিফ প্রসিকিউটর আট আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ তুলে ধরেন। ৩০ মিনিটের মতো তিনি এসব অভিযোগ পড়ে শোনান। জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে তাদের করা অপরাধের বিবরণ দেন তিনি। এ সময় গুলি করে ছাত্র হত্যা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া, গুম করা, আয়নাঘরে আটক, নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে জানান, তদন্ত সংস্থা প্রাথমিক তদন্তে যে অভিযোগ পেয়েছে তাতে এই কর্মকর্তাদের প্রত্যেকেরই ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায়’ রয়েছে। পরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য দুই মাসের সময় প্রার্থনা করলে ট্রাইব্যুনাল এক মাস সময় দেন। একই সঙ্গে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
কাঁদলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা : শুনানির সময় চিফ প্রসিকিউটর সাভারের ঘটনায় ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল কাফি, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুর ইসলাম এবং সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেন। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন মাজহারুল ইসলাম। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি কখনো সাভারে দায়িত্ব পালন করিনি। আমি ছাত্রদের পক্ষে ছিলাম।’ তখন আদালত বলেন, ‘আমরা দেখব। সম্পৃক্ততা না থাকলে ন্যায়বিচার পাবেন।’ চিফ প্রসিকিউটর পরে বলেন, ‘আমার ভুল হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম সাভারে ছিলেন না। তিনি গুলশান থানার ওসি ছিলেন। এরপর তিনি গুলশান এলাকায় হত্যা ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন।’ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাজহারুল গুলশানে দায়িত্ব পালনের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে হত্যার নির্দেশ দেন।’ অবশ্য গুলশানের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার সময় নিশ্চুপ ছিলেন মাজহারুল ইসলাম।
উত্তেজিত জিয়ার দাবি-আয়নাঘরে কখনো চাকরি করিনি : এদিন ট্রাইব্যুনালে জিয়াউল আহসানের পক্ষে আইনজীবী হিসাবে ছিলেন বোন ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার। শুনানির শেষদিকে বেশ কিছুক্ষণ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক। ওই সময় তাকে বসাতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন তিনি। আদালত এজলাস ছাড়ার আগে নাজনীন নাহার বিচারপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, জিয়াউল আহসান কথা বলতে চান। এ সময় কাঠগড়া থেকে জিয়াউল আহসান বলেন, ‘আমি আয়নাঘরে কখনো চাকরি করিনি। আমি টেকনিক্যাল দায়িত্বে ছিলাম।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আপনার আইনজীবী আছে। আইনজীবী বলার পর প্রয়োজনে যোগ করবেন।’ এরপর শুনানি শেষে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক পুলিশ প্রধান ও এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালকসহ ৮ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে বিচারপতিরা এজলাস ছাড়ার পর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আসামিদের কাঠগড়া থেকে হাজতখানায় নেওয়ার জন্য যান। এ সময় জিয়াউল আহসান তাদের বলেন, ‘কেউ আমাকে ধরবে না, কাছে আসবে না। তোমরা মার খেয়েছো, ভবিষ্যতে আরও খাবে। আমাকে জেলখানায় কাগজ-কলম দেওয়া হয় না, আমি লিখব। আমাকে কাগজ-কলম দিতে হবে। আমার বিরুদ্ধে যা বলেছে, তা আমাকে দাও। আমি দেখব।’ এ সময় তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা যায়। তবে তার আইনজীবী নাজনীন নাহার আশ্বস্ত করে বলেন, ‘পরে সবই দেওয়া হবে।’ পরে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য জিয়ার দুই হাত ধরে রাখেন। এ সময়ও তিনি তাদের হাত ছেড়ে দিতে বলেন। প্রিজনভ্যানে তোলার পর তিনি জানালা দিয়ে চিৎকার করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমি আয়নাঘরে চাকরি করিনি। আর কোনো অভিযোগ দেবেন না’।
‘জিয়া বলকানের কসাইয়ের মতো হত্যা-গুম-নির্যাতনে জড়িত’ : এদিকে শুনানিতে জিয়াউল আহসানের কর্মকাণ্ডকে রাদোভান কারাদজিচের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন বলে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জিয়াউল আহসান বিভিন্ন সময় র্যাবের বিভিন্ন পদে ছিলেন। সর্বশেষ তিনি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গুম, গুমের পরে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন, হত্যার পরে লাশ ডিসপোজাল করা, এসব কালচারের জনক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যারা বিরোধী দলে থেকে বিভিন্ন সময় কথা বলার চেষ্টা করেছে তাদের তিনি একের পর এক পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করেছেন, গুম করেছেন, বছরের পর বছর আটকে রেখেছেন। তাদের মধ্যে বহু মানুষ আজও ফিরে আসেনি।
তাজুল ইসলাম বলেন, জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে বিএনপি নেতা ইলিয়াসকে গুম করে হত্যা করা হয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ ছাড়া নাম জানা-না জানা অনেক মানুষকে অপহরণের পর নির্যাতন করা হয়েছে। তার পৈশাচিকতা নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্বিয়ান বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, যে ধরনের অত্যাচার করত, তার সঙ্গে আমরা তুলনা করেছি। বলকানের কসাইয়ের মতো বাংলাদেশের কসাই হিসাবে এই জিয়াউল আহসান হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে, গুম-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
‘মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে কাউকে হেয় করার অধিকার কারও নেই’ : এদিকে আইনজীবী নাজনীন নাহার সাংবাদিকদের বলেন, উনি (জিয়াউল আহসান) যেখানে কর্মরত ছিলেন, এটা একটা টেকনিক্যাল অফিস। ওই অফিসে কোনো আর্মড ফোর্স নেই, আয়নাঘর নেই। উনি কখনো ডিজিএফআই-এ চাকরি করেননি। আয়নাঘর নামে যে ভয়ংকর তথ্য, সেই তথ্য নিয়ে মিডিয়াতে ট্রায়াল করছে, এ ট্রায়ালটা উনার পরিবারের জন্য এবং উনার জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। একটা মানুষকে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে তাকে হেয় করার কোনো অধিকার কারও নেই। এটা বাকস্বাধীনতা নয়। সাংবাদিকতার যে আইন আছে, যে ইথিক্স আছে, সেই ইথিক্স নিয়ে আপনারা কথা বলবেন।
দেশবাসীসহ সবার কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, মিডিয়া ট্রায়াল অত্যন্ত জঘন্য জিনিস। আপনারা সেটা থেকে বিরত থাকবেন। জিয়াউল আহসানের নাম শুনলে মিডিয়া বা টেলিভিশনের সবাই শোনে। তাকে সম্পূর্ণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। উনি একজন আর্মির কর্মকর্তা ছিলেন। উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আপনারা বলে থাকেন যে উনি বরখাস্ত, উনি বরখাস্ত নন, উনি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, জুলাই-আগস্টে সারা দেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কয়েকশ অভিযোগ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে। গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। সোমবার প্রথমবারের মতো সাবেক সরকারের ১৩ মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এদিন ‘গণহত্যা’ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দিতে এক মাস সময় দেয় ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি সাবেক নয় মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে ‘গণহত্যার’ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন এ আদালত।