টিআইবি’র গবেষণাপত্র প্রকাশ
লক্ষ্য বাস্তবায়নে রোডম্যাপ নেই অন্তর্বর্তী সরকারের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও প্রতিটি ক্ষেত্রে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হলেও এই পথে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়নি বলেও জানায় সংস্থাটি।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘নতুন বাংলাদেশ : কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের পর্যবেক্ষণ’ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন টিআইবির প্রধান গবেষক শাহজাদা এম আকরাম। এতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষক মো. জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান ও মো. মোস্তফা কামাল। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকি। গবেষণাপত্রে বলা হয়, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় একদিকে রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার বহুমাত্রিক ভিত্তি ও অংশীজনের ভূমিকা রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে সরকারের চলার পথে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাস্তবায়নে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়নের সুযোগ নেওয়া হয়নি বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। বিচার ও সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক আছে উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাডহক প্রবণতা, উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও দায়িত্ব বণ্টনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়েছে। প্রশাসন পরিচালনায় সরকারের দক্ষতা ও কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সরকার পতনের পর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান। একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও দলীয়করণের পরিবর্তে আরেকটি গোষ্ঠীর প্রতিস্থাপন ও হাতবদল হয়েছে। নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে টিআইবি বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নজিরবিহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অর্জন। বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন পরিচালনায় দৃঢ়তা ও কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, পদোন্নতি ও পদায়নে অসন্তোষ রয়েছে। এছাড়া সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণ-অভ্যুত্থানে অপরাধীদের বিচার, আর্থিক খাত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার অংশ। তবে রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রোডম্যাপ এখনো অনুপস্থিত রয়েছে। একই সঙ্গে আন্দোলনে সহিংসতার সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিক মামলা দায়ের করার উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। ঢালাওভাবে মামলা হওয়ায় মূল অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি। কর্তৃত্ববাদ সরকারের পতনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা উঠে আসে টিআইবির গবেষণাপত্রে। এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ও রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত থাকার ভূমিকা ইতিবাচক।
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহলের ধৈর্যের ঘাটতি আছে বলে উঠে আসে সংস্থাটির গবেষণাপত্রে। বলা হয়, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের পক্ষ থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার প্রশ্নে কোনো কোনো মহলের ধৈর্যের ঘাটতি রয়েছে। তিন মাসেই সরকারের কার্যক্রম নিয়ে অনেক মহল হতাশ। অনেক ক্ষেত্রে দলবাজি, দখলবাজি ও আধিপত্যের সংস্কৃতি চলমান। এছাড়া রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কারের মূল চেতনা ধারণ ও রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিএনপি প্রথম থেকে সংস্কার প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও পরে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছে। একই সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও দলটির নেতাকর্মীরা দখল ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
গবেষণাপত্রে দেশের গণমাধ্যম নিয়েও কথা বলে টিআইবি। তারা বলছে, পটপরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি-হামলাসহ কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার তৎপরতা রয়েছে। যা দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি হিসাবে দেখা দিচ্ছে। সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সহনশীলতার ঘাটতি, অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন এবং বিভাজনের লক্ষণ উঠে এসেছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ভারত কর্তৃক কর্তৃত্ববাদ পতনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকারে ব্যর্থতা ও তার কারণে অপতৎপরতার ফলে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনে সরকার ও দেশের জন্য ঝুঁকি বেড়েছে।