জেটেব’র কাউন্সিলে তারেক রহমান
সরকারের অদক্ষতা জনগণ সহজভাবে মেনে নেবে না
দ্রুত নির্বাচনে যাওয়াটাই হবে সবচেয়ে কল্যাণের -মির্জা ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে রাখা দরকার জনগণের সব দাবি হয়তো তাদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার পরিচালনায় যদি অদক্ষতা পরিলক্ষিত হয় সেটাও জনগণ সহজভাবে মেনে নেবে না। রাষ্ট্র মেরামতের কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে গিয়ে অগ্রাধিকারের সেটিং যদি ভুল হয়, তাহলে জনগণের কাছে সরকারের অদক্ষতা হিসাবেই বিবেচিত হবে।
শনিবার বিকালে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (জেটেব) তৃতীয় কাউন্সিলে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এতে কাউন্সিলরদের ভোটে ফখরুল আলমকে জেটেবের সভাপতি ও রুহুল আমিন আকন্দকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজ সবার কাছে সাফল্য বলে বিবেচিত হবে না। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা আমাদের সবার ব্যর্থতা, গণতন্ত্রকামী স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের ব্যর্থতা। এই সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচার ও তার দোসররা কিন্তু বসে নেই। দেশে ও বিদেশে, প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে যড়যন্ত্রকারীরা ওতপেতে আছে, কীভাবে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়া যায়। ব্যর্থ করে দিলে গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেওয়া যাবে, দেশের কোটি কোটি মানুষ যারা গণতন্ত্রকে ভালোবাসে তাদের ব্যর্থ করে দেওয়া যাবে। এমন একটা পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত মনে হয়, জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা সেখানে ভ্রূক্ষেপ করতে চাচ্ছে না। বরং তারা যেটা ভালো মনে করছে, সেটাই হয়তো চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। অনেক অপ্রাপ্তি থাকার পরও জনগণ কিন্তু এখনো এই সরকারের ওপর আস্থা রাখছে। জনগণ আস্থা হারাতে চাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে-সরকার কী জনগণের ওপর আস্থা রাখতে চায়? কারণ জনগণের সঙ্গে সরকারের আস্থার সম্পর্ক নিবিড় থাকলে, ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্রের ডালপালা বিস্তারের সুযোগ পাবে না।
জনগণ ভোটের অধিকারের নিশ্চয়তা পেলে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে গণতন্ত্র, উন্নয়ন কিংবা সংস্কার নিয়ে আমরা যত যা-ই বলি না কেন, কোনোটিই টেকসই হবে না। একজন নাগরিকের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ভোট প্রয়োগের অধিকার। জনগণ ভোট প্রয়োগের অধিকার যদি না পায়, তাহলে রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক তা সৃষ্টি হবে না। আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণ আশা করছে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ পরিবেশে, নির্ভয়ে ভোট দিতে সক্ষম হবে। জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে। বিশ্বাসযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট আস্থা পেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বন্ধন আরও দৃঢ় হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। জনগণ যখন বুঝবে যে, সত্যিকার অর্থে তাদের ভোটের অধিকারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে, স্বাভাবিকভাবে বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।
তারেক রহমান বলেন, প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে আহত করে, ২ হাজারের মতো ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। পতিত স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালানোর পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটি প্রশাসন ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাফিয়া সরকার (আওয়ামী লীগ) প্রায় ১৫ বছরের তৈরি করা যে জঞ্জাল, তা তিন মাসে দূর করা সম্ভব নয়। তবে তিন মাস পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিকও নয়।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জুলাই-আগস্টের যে গণ-অভ্যুত্থান, সেখানে আমরা দেখেছি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বহু মানুষের অঙ্গহানি হয়েছে। আহতরা সুচিকিৎসার দাবি নিয়ে যেভাবে হাসপাতাল থেকে রাজপথে বেরিয়ে এসেছে, তা সমগ্র দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর দৃশ্য। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে গণ-অভ্যুত্থান সেখানে আহতদের চিকিৎসা, নিরাপত্তা কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। থাকলেও কত নম্বরে ছিল? বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার যে পদক্ষেপ, যেটা নিয়ে সমাজের প্রতিটা মানুষ, প্রত্যেকটি পরিবার কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এই বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারের তালিকায় কত নম্বরে আছে জনগণ জানতে চায়।
তারেক রহমান বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জনগণের জীবনযাত্রা একটু ভালো করা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা আরও ভালো করা। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরও উন্নত করা। অতীতে বিএনপি যখনই সুযোগ পেয়েছে জনগণের সমর্থন নিয়ে দেশ পরিচালনার, যতটুকু সম্ভব প্রতিবারই চেষ্টা করেছে এসব কাজগুলো করার জন্য।
তিনি বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশের আরও নতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। আমরা আশ্বাস দিয়ে বলতে চাই, জনগণের রায়ে বিএনপি যদি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় সুযোগ পায়, বিদেশে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গার্মেন্ট এবং টেক্সটাইল ছাড়াও যেগুলো শতভাগ রপ্তানিযোগ্য পণ্য, আমাদের চিন্তাভাবনা আছে, সেগুলোর ওপর কীভাবে এলসির সুযোগ দেওয়া যায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, বাংলাদেশের গার্মেন্ট এবং টেক্সটাইল সেক্টরের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে নানারকম যড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের সময় কারখানার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের বেশি ছিল। বর্তমানে সংখ্যা কমে প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর শিল্পের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র চলছে। সতর্ক থাকার পাশাপাশি রপ্তানি বাজারের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য নিজেদের সক্ষমতাও আরও বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি শিল্পের বিকাশ ঘটানোও প্রয়োজন। কাঁচামালের জন্য আমাদের যে নির্ভরতা আছে, এটা কমিয়ে আনার জন্য আগামীর দিনগুলোতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তার দলের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তা হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, গণতান্ত্রিক সমাজের, সেই আকাঙ্ক্ষাটাকে বাস্তবায়িত করতে আমাদের যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো দূর করতে হবে। তার বেশি কিছু করতে গেলে সময় যত বেশি যাবে তত বেশি সমস্যা তৈরি হবে। আমি কথাটা স্পষ্ট করে বলতে চাই, নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সমস্যাগুলো আছে, এগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। আশা করব নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এগুলো সংস্কার করেই অতিদ্রুত নির্বাচনে যাওয়াটাই হবে এ দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে কল্যাণের।
জেটেবের সভাপতি ফখরুল আলমের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, অধ্যাপক ফরহাদ হালিম ডোনার প্রমুখ।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত ড. ক্যাথারিনা উইজার। শনিবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত। ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাতে অস্ট্রিয়ার বাংলাদেশের কনস্যুলার তাজভীরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
চেয়ারপারসনের কার্যালয় জানায়, বিএনপি মহাসচিব দুই দেশের স্বার্থসংশিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ক্যাথারিনা বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হলেও দেশটির দূতাবাস ভারতের দিল্লিতে। তিনি দক্ষিণ এশীয় কয়েকটি দেশে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।