রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা ও আস্থার সংকট
ঋণপ্রবাহে বড় পতন
বেসরকারি খাত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে বড় ধরনের ছন্দপতন দেখা দিয়েছে। গত চার বছরের মধ্যে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-তিন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর চার বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে একই সময়ে এই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতি জুলাই-সেপ্টেম্বরে সোয়া ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। গত চার বছরের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার কমার জন্য সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরপর তিন দফা বন্যা এবং উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন, কয়েক দফা বন্যার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা কমেছে। একই কারণে শিল্প খাতে উৎপাদনেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে এতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের কারণে দেশের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ৮ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না। ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন দাবিতে বিভিন্ন পেশার লোকজনের আন্দোলন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতাও যোগ হয়। এর মধ্যে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তিন দফা বন্যা হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব কারণেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন খাতে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করায়ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে উদ্যোক্তাদের মধ্যেও একধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে তারাও বিনিয়োগ থেকে এখনো মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন।
সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুটপাট, দুর্নীতি, টাকা পাচারের কারণে অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল, তা বর্তমান সরকারের আমলে ঘুরে দাঁড়াবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারেনি। সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। পরিস্থিতি পুরো স্বাভাবিক করতে তাদের সময় দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে দেশের বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের লোকজন এখন বেশির ভাগই পলাতক। ফলে তাদের ব্যবসা এখন স্থবির। দুর্নীতির টাকা দেশের অর্থনীতিতে এখন সচল নয়। অর্থনীতির বড় একটি অংশ দুর্নীতির টাকায় পরিচালিত হয়। এছাড়া নতুন সরকারের কারণে পরিস্থিতি দেখছেন উদ্যোক্তারা। রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর পরের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় দশমিক ৬৪ শতাংশে, যা বর্তমান সময় থেকে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। ওই সময়ে বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও মন্দা ছিল। যে কারণে এ খাতে ঋণের প্রবাহ কমেছিল। এরপর থেকে ঋণের প্রবাহ বাড়তে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৬ শতাংশে। ওই সময়ে বাংলাদেশসহ বৈশ্বিকভাবে করোনা সংক্রমণের কারণে লকডাউন চলছিল। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ওই সময়ে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো হয়েছিল। যে কারণে ঋণের প্রবাহ বেড়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে দেখা দেয় বৈশ্বিক মন্দা। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশের পাশাপাশি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হারও বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮৪ শতাংশে। এর পরের অর্থবছরে (২০২২-২৩) বৈশ্বিক মন্দার প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে আমদানি ব্যয়ও বাড়ে। এতেও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়ে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বেড়ে ২ দশমিক ০৯ শতাংশে ওঠে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে মন্দার প্রভাব কমতে থাকে। একই সঙ্গে মন্দার কারণে সৃষ্ট ডলার সংকট মোকাবিলায় নেওয়া আমদানি সংকোচন নীতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আবার কমতে থাকে। ফলে গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আগের অর্থবছরের থেকে কমে ১ দশমিক ২৬ শতাংশে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে জুলাইজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে ঋণপ্রবাহও কমেছে। ফলে জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ দশমিক ৩২ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব ও মুদ্রানীতির কারণে ঋণপ্রবাহ কমেছিল। গত অর্থবছরের জুলাইয়েও এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫৯ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। গত জুলাইয়ের চেয়ে আগের বছরের জুলাইয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি কমেছিল। ওই সময়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মুদ্রানীতির কারণে ঋণপ্রবাহ কমেছিল। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে গত তিন অর্থবছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণে লাগাম পড়েছে। চলতি অর্থবছরে মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করা হয়েছে। নতুন সরকার এসে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করেছে। জুলাই-আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের গতিপ্রকৃতি আগের মাসের নেতিবাচক অবস্থা থেকে কিছুটা বেড়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় দশমিক ০৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ০৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৬৭ শতাংশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় দ্বিগুণ।
সূত্র জানায়, মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতেই সিংহভাগ ঋণ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি সাড়ে ২১ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকা। সরকারি খাতে ঋণ মাত্র ৪ লাখ কোটি টাকা। এ কারণে বেসরকারি খাতকে অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। মোট কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে মাত্র ৫ শতাংশ। এ কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলে এর নেতিবাচক প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়ে।