ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু ভর্তি ১২১১
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ যেন কোনোভাবেই কমছে না। দিন যত যাচ্ছে হাসপাতালগুলোতে এডিস মশাবাহী রোগটিতে আক্রান্তদের ভিড় ততই বাড়ছে। শয্যা সংকটে রোগীরা কোথাও হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, কোথাও এক বিছানায় দুজন করে ভর্তি আছেন। সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, এডিস মশার প্রকোপ বাড়ায় রোগী বাড়ছে। নির্ধারিত শয্যাগুলো প্রায় সময় রোগীতে পূর্ণ থাকছে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বহির্বিভাগের মেডিসিন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রায় অর্ধেকই জ্বর উপসর্গ নিয়ে আসছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেশির ভাগের ডেঙ্গু পজেটিভ ফলাফল আসছে। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারায় সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও সাতজন মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেলেন ৩৬৭ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে এক হাজার ২১১ জন ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৪ হাজার ৮০০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৃতদের মধ্যে তিনজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন। ঢাকার বাইরে বরিশাল ও চট্টগ্রামে বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি এলাকার ২২১ জন ও ঢাকা দক্ষিণে ১৯০ রয়েছেন। এ ছাড়াও ঢাকা বিভাগে ২৯১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩৯ জন, খুলনা বিভাগে ১৩০ জন, বরিশাল বিভাগে ১০৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৩ জন, রংপুর বিভাগে ১৮ জন এবং সিলেট বিভাগে চারজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক ১২টা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১৪ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ৩নং বিছানায় মায়ের কোলে নেতিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় সাড়ে তিন মাস বয়সি শিশু জান্নাতুলকে। একই বিছানায় ভর্তি রয়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত আরেক শিশু। এক বিছানায় দুজন ভর্তির বিষয়ে জান্নাতুলের মা রিনা খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, দিন কয়েক আগে বাচ্চার জ্বর আসে। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও বমি। কোনোভাবেই কান্না থামছিল না। সোমবার গাবতলী মেটার্নিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার ডেঙ্গু টেস্ট দেন। রিপোর্ট পজেটিভ আসে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ায় রাত ১২টায় এখানে নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা দ্রুত ভর্তি করে নেন। শয্যা খালি না থাকায় আরেক রোগীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে। ওয়ার্ডের দুজন নার্স জানান, ৩১৪নং শিশু ওয়ার্ডে ৪০টি বিছানা রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের আলাদা করে ভর্তি রাখা হয়েছে। বর্তমানে আটটি বিছানার চারটিতেই (৫, ৭, ৮, ৯নং) দুজন করে রোগী ভর্তি রয়েছে। মঙ্গলবার ভর্তি ছিল ৯ জন।
মেডিকেল অফিসার ডা. সাবরিনা বলেন, ডেঙ্গুতে শিশুদের ঝুঁকি বেশি। এখানে ভর্তি রোগীদের বেশির ভাগই দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। অভিভাবকরা আক্রান্তদের বমি, পেটব্যথা, খাবার খেতে অনীহার কথা বলছেন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে রোগীরা বাড়ি ফিরছেন। এবার এখন পর্যন্ত কোনো শিশুর মৃত্যু হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পঞ্চম তলার ‘এ’ ব্লকের ৫২৯নং পুরুষ ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ৮০টি শয্যা রয়েছে। মঙ্গলবার ভর্তি ছিল ৬২ জন। সিনিয়র স্টাফ নার্স ফ্লোরেন্স মিঠু হালদার বলেন, ১ থেকে ১১ নভেম্বর (সোমবার) পর্যন্ত ৭০৯ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শনিবার ৭৬, রোববার ৬৬, সোমবার ৭৬ এবং মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত দশজন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া ষষ্ঠতলায় ৬৪০নং ডেঙ্গু মহিলা ওয়ার্ডে ৫০ জনকে ভর্তি থাকতে দেখা যায়। সোহরাওয়ার্দীর পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রোগীর ভিড় দেখা যায়। ঢামেকের নতুন ভবনে সপ্তমতলায় শয্যা না পেয়ে অনেক ডেঙ্গু রোগীকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি বছর ঢামেকে দুই হাজার ৬৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ৬৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৭ জন ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে আছে ১২৪ জন।
চলতি বছর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ৫৮৬ জন ভর্তি এবং মারা গেছে পাঁচজন। গত এক দিনে ভর্তি হয়েছে ১০ জন। বর্তমানে ভর্তি আছে ৪৬ জন। এ বছর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ১১৫ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ৩৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫১ জনসহ মোট ভর্তি আছেন ১৩৩ জন।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে। গত শুক্রবার সকালে জ্বরে আক্রান্ত হন হাজারীবাগ এলাকার ১২ বছরের কিশোর শুভ্র (ছদ্মনাম)। রক্ত পরীক্ষা করে শনিবার রাতে ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। শুভ্রর বাবা যুগান্তরকে জানান রোববার রাতে জ্বরের তীব্রতা বাড়ায় ছেলেকে ধানমন্ডির (শংকর) ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যান। শয্যা ফাঁকা না থাকায় পাশেই আরেকটি বেসরকারি হাসপতালে যাই। সেখান থেকেও নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। ওই রাতেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করলে চিকিৎসক জানান এই মুহূর্তে সিট খালি নেই, সকালে আসলে ভর্তি নিতে পারবেন। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রাত কাটানোর পর অবশেষে সোমবার ছেলেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে সক্ষম হই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এসএম হাসিবুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও আমাদের হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মশারির মধ্যে রাখতে হয়। ফলে শয্যার বাইরে কোনো রোগী রাখা হচ্ছে না। অক্টোবর ও নভেম্বরে রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। জ্বর উপসর্গ নিয়ে বহিঃ ও জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের জন্য ‘ফিভার ক্লিনিক’ খোলা হয়েছে। সেখান থেকে ট্রায়াজ সিস্টেমে রোগীদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ভর্তি বাড়লেও তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুতে গতবারের চেয়ে কম মৃত্যু হচ্ছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুজ্বরে প্রথম দিকে সতর্ক না হওয়ায় অনেক রোগী শকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যথাসময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে মশক নিধনে জোর দিতে হবে। কারও জ্বর হলেই বা ডেঙ্গু সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টের নির্দেশ : রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এক রিটের শুনানি শেষে মঙ্গলবার বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে বলেছেন আদালত।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান। তিনি জানান, ইতোমধ্যে সাড়ে তিনশ’র ওপরে মৃত্যু ঘটেছে। ৭২ হাজার ‘ডিটেকটেড’ হয়েছে। এটা আনুষ্ঠানিক হিসাব। অনানুষ্ঠানিক হিসাবে আরও বেশি হতে পারে।
ব্যারিস্টার মাহিন বলেন, কলকাতা তাদের ডেঙ্গু সমস্যা অনেকদূর মিটিয়ে ফেলেছে। মালয়েশিয়াও করেছে। এগুলো আদালতে বলেছি। আদালতের ভিউ হচ্ছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের ওপর সরকারের বেশি মনোযোগ প্রয়োজন। কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আদালত ৩০ দিন সময় দিয়েছেন। আর ৬০ দিনের মধ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে বলেছেন। এ কমিটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করবেন।