গাজীপুরে ৬১ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়লেন শ্রমিকরা
গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গাজীপুরে টানা ৬১ ঘণ্টা পর সোমবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবরোধ প্রত্যাহার করেছেন টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকরা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ১০টার দিকে শ্রমিকরা মহাসড়কের অবরোধ তুলে নেন। এতে ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে শ্রমিক অন্দোলনের কারণে সোমবার আরও ১৫টি পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এর আগে রোববার ৩০টি কারখানায় ছুটি দেওয়া হয়েছিল।
পুলিশ ও আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানায়, মহানগরীর মোগরখাল এলাকার টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড গ্রুপের শ্রমিকরা শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী কলম্বিয়া এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। শ্রমিকদের দুই মাসের (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) বেতন বকেয়া রয়েছে। কর্তৃপক্ষ একাধিকবার আশ্বাস দিয়েও তা পরিশোধ করেনি। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর নির্ধারিত তারিখে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কথা থাকলেও ওইদিন তা পরিশোধ না করে কর্মকর্তারা কারখানা তালাবদ্ধ করে চলে যান। এরপর থেকে মালিকপক্ষের লোকজন কারখানায় আসেননি। এমনকি কারখানাটির উৎপাদনকাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে কারখানায় এসে ফিরে যান। এর জেরেই আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। এতে ওই মহাসড়কের উভয় পাশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। রাতেও তারা সড়কের ওপর অবস্থান করেন। অবরোধের কারণে রোববার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় দিকে প্রায় ২০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার সকাল থেকে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ মিয়াসহ সেনাবাহিনী, র্যাব, শিল্প ও থানা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ইউএনওর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচএম শফিকুজ্জামান শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের এ কথোপকথন মাইকে প্রচার করা হয়। এ সময় শিল্প সচিব শ্রমিকদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোববারের মধ্যে সরকারের উদ্যোগে ছয় কোটি টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হবে। অবশিষ্ট টাকা পরিশোধের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের জন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বন্ধক রাখা হবে। এ সময় তিনি জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। তার এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুপুর সোয়া ২টার দিকে শ্রমিকরা মহাসড়কের অবরোধ প্রত্যাহার করেন। পরে শ্রমিকদের ২৫-২৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ইউএনও এরশাদ মিয়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হন।
অবরোধ প্রত্যাহারের প্রায় ১ ঘণ্টা পর বিকাল ৩টার দিকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের একটি অংশ ফের ওই এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। তারা পাওনা পরিশোধ দাবির সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন জানান, সোমবার বিকালে টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড গ্রুপের আন্দোলনরত শ্রমিকরা তাদের পাওনা টাকা পরিশোধের বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মতি প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের ৩১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বিকালে শ্রম মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানে তারা ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচএম শফিকুজ্জামানের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত এ আলোচনা চলে। এ সময় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন বাবদ মোট ১৬ কোটি টাকা শ্রম মন্ত্রণালয়ের সরকারি তহবিল থেকে দুই দফায় পরিশোধ করা হবে। ওই টাকার মধ্যে প্রথম দফায় রোববার ছয় কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় বাকি ১০ কোটি টাকা ৩০ নভেম্বর পরিশোধ করা হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে এ টাকা মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেবে। এ ছাড়াও ওই গ্রুপের বন্ধ পাঁচটি কারখানা শিগগিরই চালু করা হবে। কারখানা চালু হলে শ্রমিকরা তাদের কাজে যোগ দেওয়ার অঙ্গীকার করেন ওই সভায়। এর আগে বকেয়া বিলের কারণে কেটে দেওয়া কারখানার বিদ্যুতের সংযোগ পুনরায় সংযোগ দেওয়ার জন্য শ্রম সচিব ফোনে পল্লী বিদ্যুতের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান। এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক প্রতিনিধিরা সম্মতি জানিয়ে মহাসড়ক থেকে তাদের অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিলে রাত ১০টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ মিয়া ও টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হেদায়েতুল হকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।