Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রউফ তালুকদারের সিদ্ধান্তের মাশুল গুনছে ব্যাংক

কয়েকটি ব্যাংক আমানত হারায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা

Icon

হামিদ বিশ্বাস

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রউফ তালুকদারের সিদ্ধান্তের মাশুল গুনছে ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দুর্বল ব্যাংক মার্জারের একগুঁয়েমি এবং ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গুনছে এখনও অনেক ব্যাংক। চলতি বছরের শুরুর দিকে জোর করে ব্যাংক মার্জারের ঘোষণায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমানত উত্তোলনের হিড়িক পড়ে যায়।

এ ঘটনায় কম-বেশি হাফ ডজন ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দায় সরাসরি সাবেক পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে নিতে হবে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, তার জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার আমানত হারিয়েছে। সে ক্ষত এখনও পুরোপরি সেরে উঠেনি। তবে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এখন ব্যাংকে আমানত রাখলে আগের মতো ঝুঁকি কম। অনেক ব্যাংকে আমানত ফিরতেও শুরু করেছে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ ঘোষণা এলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা হবে। এরপর বলা হয়, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত কে কাকে নেবে বলো। এভাবে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত শুধু খারাপ-ই নয় বরং অনেক বিপজ্জনক ছিল। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে খারাপের পাশাপাশি অনেক ভালো ব্যাংকও বিপদে পড়েছে। আমানত হারিয়েছে অনেক ব্যাংক।

জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আকস্মিকভাবে আমানত উত্তোলনের চাপ তৈরি হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ও জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূতকরণ সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশের পর উত্তোলনের চাপ বেড়ে যায়। এরপর পৃষ্ঠপোষক ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমানত তুলে নেয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এবি ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, আমানত কমে ৩১ আগস্ট শেষে ৩২ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকায় নেমেছে। ডিসেম্বর শেষে যা ৩৫ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা ছিল।

জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল যুগান্তরকে বলেন, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই চলতি বছরের শুরুর দিকে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগের কথা জানান তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই সময় যে ১২টি ব্যাংক আলোচনায় ছিল সেখানে এবি ব্যাংকসহ আরও অনেক ব্যাংকের নাম ছিল। আকস্মিকভাবে একীভূতকরণ চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তখন পুরো ব্যাংক খাত থেকে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে। অনেকেই তখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছিলেন। যে কারণে অনেকটা নীরবে ওই উদ্যোগ থেকে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুরুতে ১০-১২টি ব্যাংকের কথা বলা হলেও পরে তা পাঁচটিতে থেকে যায়।

তৎকালীন গভর্নর একে একে চেয়ারম্যান, এমডিকে ডেকে এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা, সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল, কৃষির সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, সিটির সঙ্গে বেসিক এবং ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য সরকার পরিবর্তনের পর সেই আলোচনা থেমে গেছে।

বেসিক ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিলে জোর করে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন আমানতকারীরা। যদিও ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু আমানত ফিরে এসেছে। তবে আগের অবস্থায় যেতে পারেনি। বেসিক ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু মো. মোফাজ্জল যুগান্তরকে বলেন, সে সময় হঠাৎ একীভূতকরণ সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেসিক ব্যাংক। তখন অনেকে আমানত তুলে নিয়ে গেছেন। পরে উঠানামার মধ্যেই ছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

বিডিবিএল সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) একীভূত হওয়ার মৌখিক নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এরপর ৮ এপ্রিল একীভূত হওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেয় বিডিবিএলের পরিচালনা পর্ষদ। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উভয় ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এ খবর গণমাধ্যমে প্রচার এবং প্রকাশ হওয়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমানত তুলে নেন অনেকে। পরে জানা যায়, এ বিষয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে সম্মতি দিয়েছে বিডিবিএল। গভর্নরের কড়া নির্দেশনা থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিষয়টি মেনে নেন তারা।

বিডিবিএলের সদ্য বিদায়ি এমডি মো. হাবিবুর রহমান গাজী বলেন, চাপিয়ে দেওয়া প্রডাক্টের মতো সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ছিল। এতে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিডিবিএল অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জবরদস্তিমূলক একীভূত করার সিদ্ধান্ত মানবে না সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। ব্যাংকটির সাবেক এমডি বলেন, সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে জোর করে একীভূত করতে চেয়েছিলেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে আতঙ্কে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে যান আমানতকারীরা।

তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। তখন যারা আমানত নিয়ে গেছেন, তাদের অনেকে এখন ফেরত দিচ্ছেন। তার দাবি, সরকারের নীতি-সহায়তা পেলে দু-এক বছরের মধ্যেই শক্তিশালী ব্যাংকের তালিকায় উঠে যাবে বিডিবিএল। কারণ দায়ের তুলনায় সম্পদ বেশি রয়েছে ব্যাংকটির।

একই চিত্র নতুন প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকেরও। পদ্মা ব্যাংক সূত্র জানায়, পদ্মা ব্যাংকের আমানত ছিল ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আব্দুর রউফ তালুকদারের একীভূত সিদ্ধান্তের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তুলে নিয়ে যায় আমানতের প্রায় ১০ শতাংশ বা ৬০০ কোটি টাকা। যা এখনও ফেরত আসেনি।

জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মো. তালহা যুগান্তরকে বলেন, তখন প্রায় ৫০০-৬০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন আমানতকারীরা। এখনও সে টাকা ফেরত আসেনি। ফলে আমানতকারীদের কাঙ্ক্ষিত টাকা ফেরত দিতে পারছি না।

সূত্র জানায়, তখন অন্যান্য ব্যাংকেও আতঙ্ক দেখা দেয়। তারল্য নিয়ে গভীর সংকটে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকসহ আরও অনেক ব্যাংক। আমানত সংকটের তালিকায় পরে যোগ হয় এস আলমের ব্যাংকগুলো।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই এবং মূল্যায়ন ছাড়া ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শুধু ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিকে ডেকে পাঠিয়ে একীভূত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যা কিছুতেই যৌক্তিক ছিল না। মূলত মার্জার হয় উভয়পক্ষের সম্মিতির ভিত্তিতে। সেটা এখানে ছিল না। তখন অনেক ব্যাংক বিরোধিতাও করেছিল। কিন্তু তা শোনা হয়নি। মনে হয় উপরের একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছিল। যদিও এখন সে সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর যে ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। অনেক ব্যাংক আমানত হারিয়েছে। তবে আমানতকারীদের বলব, এখন সমস্যা নেই। আমানত রাখতে পারেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম