কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার
বৈশ্বিকভাবে কমলেও বাড়ছে বাংলাদেশে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনাগত পদক্ষেপের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করতে হবে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রায় আড়াই বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ফলে তারা নীতি সুদহার কমাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ নীতি সুদের হার একদফা কমিয়েছে। আগামীতে আরও একদফা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ৩ অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। এতে বাজারে সব ধরনের সুদহার বেড়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এখনও এ হার ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে নীতি সুদের হার যখন কমছে, তখনও বাংলাদেশ এ হার বাড়িয়েই যাচ্ছে। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর থেকে আরও একদফা এ হার বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে ব্যাংক রেটকে নীতি সুদের হার হিসাবে গণ্য করত। এখন ট্রেজারি বিল পুনরায় কিনে নেওয়ার চুক্তি বা রেপো সুদের হারকে নীতি সুদহার হিসাবে গণ্য করা হয়। অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদের হার জাদুকরী ফল দিলেও বাংলাদেশে তা খুব বেশি কার্যকর হয় না।
২০২২ সালের শুরু থেকে বৈশ্বিক মন্দার কারণে বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেলে অনেক দেশ নীতি সুদের হার বাড়িয়ে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ফলে তারা এখন নীতি সুদের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ২০২২ সালের মে থেকে নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে। ওই সময়ে এ হার ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। গত আড়াই বছর ধরে নীতি সুদের হার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। উলটো এ হার আরও বেড়েছে। ২০২০ সালে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ শতাংশের ঘরে।
২০২২ সালের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। জুলাইয়ে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠেছিল। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নামে। অক্টোবরে আবার বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে ওঠে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, নীতি সুদের হার বাড়ানোর কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে। অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া বন্ধ করা হয়েছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্যের প্রান্তিক পর্যায় থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামের ব্যবধান অনেক বেশি। এটি বাজার ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটি রয়েছে তা ইঙ্গিত করছে। এ ত্রুটি নিরসন করতে হস্তক্ষেপ করা হলে মূল্যস্ফীতির হার আরও কিছুটা কমে আসবে।
সূত্র জানায়, করোনার সময় বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সচল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর নীতি গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই রেপো সুদের হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ওই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ শতাংশের ঘরে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়।
মন্দার প্রকোপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাংলাদেশও এর দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকে। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফলে ২০২২ সালের মে থেকে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি সুদের হার আবার বাড়াতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৯ মে এ হার বাড়িয়ে আবার ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। একই বছরের ৩০ জুন এ হার আরও বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। জুলাইয়ে ঘোষিত মুদ্রানীতিকে সংকোচনমুখী করা হয়। বাড়ানো হয় নীতি সুদের হার। একই বছরের ২ অক্টোবর আরও বাড়িয়ে রেপো সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি।
২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে তা আরও বাড়িয়ে ৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১ জুলাই থেকে আরও বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। ৫ অক্টোবর থেকে আরেক দফা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ২৭ নভেম্বর থেকে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়। তাতেও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে রেপো সুদের হার আরও একদফা বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়। ৯ মে থেকে আরও বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তিন দফায় রেপো সুদের হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার কথা ঘোষণা দেন। তিন দফায় তিনি সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ শতাংশে উন্নীত করেন। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পর থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সামান্য কমেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, বাংলাদেশে মুদ্রানীতির উপকরণগুলো সাধারণত বেশি কাজ করে না। কারণ এখানে কালো অর্থনীতির প্রভাব বেশি। যে কারণে মুদ্রানীতির উপকরণ দিয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ খুব বেশি কমানো যায় না। এজন্য মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয় না। মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ একটি উপকরণ। এর সঙ্গে বাজার তদারকিতে বেশি জোর দিতে হবে। তা হলে এ হার কমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তারপর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বন্যার কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণেও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারের কেন্দ্রীয়সহ স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা এখনও ঠিকভাবে কাজ করছে না। এতে তদারকি ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছে। যে কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্যের ঘাটতিতে সঠিক পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না।
আইএমএফের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলা করে অনেক দেশই এখন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে তারা ঋণের সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী থেকে নিুমুখী করতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সেপ্টেম্বরে নীতি সুদের হার সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। তারা এ হার আগামীতে আরও কমানোর পূর্বাভাস দিয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। ২০২২ সালের তা সর্বোচ্চ প্রায় ১০ শতাংশে ওঠেছিল।
জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন ধরনের নীতি সুদের হার কমিয়েছে। এর মধ্যে ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি রেট বা ডিএফআর ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ করেছে। প্রধান পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার সুদ সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। প্রান্তিক ঋণ সুবিধার সুদ ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন কমে ২ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। আগে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
আগস্টে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের নীতিনির্ধারণী ভিত্তি সুদের হার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। আগে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ব্র্রাজিল গত বছরের আগস্টে নীতিনির্ধারণী সুদের হার ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে। এসব দেশ নীতি সুদের হার আরও কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। আগে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্চে তাদের নীতি সুদ ক্যাশ রেট ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
জুনে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১ শতাংশে ওঠেছিল। আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। সেপ্টেম্বরে তা ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। অক্টোবরে তা আবার বেড়ে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠেছে। কিন্তু এ হার দীর্ঘ সময় ধরে ডাবল ডিজিটে রয়েছে। ফলে খাদ্য নিয়ে ভোক্তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নীতি সুদের হার সোয়া ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করেছে। ওই হার এখনও বহাল রয়েছে। তারা নীতি সুদ না বাড়ালেও কমায়নি। দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। আগে ছিল ৮ শতাংশের বেশি।
অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলংকা ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে।