Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি

সময় সীমিত পথ দুর্গম

চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ * কাজ করছে ১০ সংস্কার কমিশন * ব্যাংকিং খাতে টাস্কফোর্স গঠন, দুর্নীতি শনাক্তে শ্বেতপত্র কমিটি * বিপুল জনসমর্থনের পাশাপাশি বিদেশিদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সময় সীমিত পথ দুর্গম

সময় সীমিত, পথ দুর্গম। অনেক রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে শুরু হয় মহাসড়কে কঠিন এ যাত্রা। যেতে হবে বহুদূর। হয়তো কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে পায়ের চিহ্ন। এ লক্ষ্যেই চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তিন মাস পার করেছে। এর মধ্যে কোনোটি দৃশ্যমান, আবার কোনোটি অদৃশ্য চ্যালেঞ্জ। তবে সম্ভাবনাও ছিল বিশাল। প্রথমত দেশের মানুষের নজিরবিহীন সমর্থন এবং দ্বিতীয়ত উন্নয়ন সহযোগীসহ বহির্বিশ্বের সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার আশ্বাস। কিন্তু তিন মাসে সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানো যায়নি। সরকার বলছে সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের পথ চলতে চায়।

ছাত্র-জনতার ১ মাস ৪ দিনের আন্দোলনে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিনদিন পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু। তবে পুরো দেশ ছিল অগোছাল ও বিচ্ছিন্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত দ্রুত হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, সেটি গ্রহণ করার প্রস্তুতি কারও ছিল না। ফলে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথচলা। তিন মাসে অর্জন ও ব্যর্থতা পাশাপাশি রাখলে হয়তো ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হবে। সাদা চোখে সন্তোষজনক বড় অর্জন হয়তো নেই। তবে সম্ভাবনা বিশাল। আশার কথা হলো ইতোমধ্যে কিছুটা গুছিয়ে উঠতে শুরু করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল এগুলো হলো আইনি জটিলতা, আস্থা ফেরানো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, ভঙ্গুর অর্থনীতি দাঁড় করানো, রাজনীতি চলমান রাখা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা। কয়েকটি ক্ষেত্রে সফলতা আছে। ব্যাপক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষায় ১০টি কমিশন গঠনসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। এ খাতের উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের পূর্বাভাসে চলতি বছরের জন্য বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা ভালো নয়। তবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে। এটি কতদিন থাকে, সেটি দেখার বিষয়। তিনি বলেন, আগামী দিনে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটি বলা কঠিন। এটি আরও কিছুদিন পর বোঝা যাবে। সরকারি তথ্য অনুসারে, দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের ১২টি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে মোট ৫৬টি। এর মধ্যে ৩৯টি বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়া দুটি নীতিমালা ও ৮টি চুক্তি অনুমোদন এবং ১০টি অধ্যাদেশ জারি করেছে।

সংস্কার কমিশন গঠন : হাসিনা সরকারের পতনের ১ মাস ৬ দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ১ মাস ৩ দিনের মাথায় ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বহুল আলোচিত ৬টি খাত সংস্কারে সুনির্দিষ্ট কমিশনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রধান করা হয় সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিব সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। আগামী তিন মাস অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশ জমা দেবে ৬টি কমিশন। এরপর ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করবে সরকার। চূড়ান্ত পর্যায়ে শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। সেখানে এ রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, এর একটি ধারণাও দেওয়া থাকবে। সংস্কারের রূপরেখা চূড়ান্ত হলে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এছাড়াও আরও ৪টি কমিশন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ খান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বিশিষ্ট কলামিস্ট কামাল আহমেদ, শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রধান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সৈয়দ সুলতানউদ্দিন আহমেদ এবং নারীবিষয়ক কমিশনের প্রধান নারীপক্ষের শিরিন পারভীন হক।

সংস্কারের অগ্রগতি : রাষ্ট্র সংস্কারে কমিশন গঠনের এক মাস পর ৪ নভেম্বর কমিশনপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময়ে সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন অগ্রগতির কথা জানানো হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ শুরু করেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় হচ্ছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ১০টি সভা করেছে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে আরও চারটি বৈঠক করেছে। জনসাধারণের মতামত চেয়ে একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যা ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরিতে দুর্বলতা চিহ্নিত করতে কাজ করছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকা সমন্বয় করা হচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অংশীদারদের পরামর্শ নিচ্ছে তারা।

দুর্নীতি শনাক্তে শ্বেতপত্র কমিটি : ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা মূল্যায়ন করে রিপোর্ট তৈরির জন্য শ্বেতপত্র প্রস্তুত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এছাড়াও কমিটিতে আরও ১১ সদস্য রয়েছেন। কমিটি তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে।

ব্যাংকের টাস্কফোর্স : দেশের বহুল সমালোচিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ১১ সেপ্টেম্বর ৬ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর প্রধান হলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। সঙ্গে আরও ৬ সদস্য রয়েছেন। এ টাস্কফোর্স প্রধানত আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ এবং প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথক্করণসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

ব্যয় কমানো : হজের ব্যয় ও জ্বালানির দাম কিছুটা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে হজে যেতে সাধারণ প্যাকেজে ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সেখান থেকে ব্যয় ১ লাখ ৬ হাজার ৬৪৪ টাকা কমানো হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৫ সালে হজ্বের সাধারণ প্যাকেজ ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। এছাড়াও আগামী বছর সরকারিভাবে বিশেষ প্যাকেজ থাকছে না। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানো হয়েছে।

সুসংবাদ নেই শেয়ারবাজারে : দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম আলোচিত বিষয় শেয়ারবাজার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যান্য খাতের সঙ্গে শেয়ারবাজারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন নেতৃত্ব এবং বাজার সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত।

আস্থা ফেরানো : বিগত সরকারের অন্যতম সমস্যা ছিল মানুষের আস্থার অভাব। বিশেষ করে পরিসংখ্যানগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এছাড়াও নির্বাচন, গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি, গুম, খুন এবং রাষ্ট্রীয় মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব তথ্য প্রচার করা হতো, এর অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করত না। এ অবস্থায় মানুষের মাঝে আস্থা ফেরানো সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল। এ সময়ে টানা এক সপ্তাহ কর্মবিরতি পালন করেছে পুলিশ। ফলে ট্রাফিকব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। থানাগুলোয় পুলিশ না থাকায় দেশব্যাপী ডাকাতের আতঙ্ক ছিল। এ সময়ে পাড়া-মহল্লায় মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। তবে এক সপ্তাহ পর কাজে ফিরেছে পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনা ও শিল্পকারখানা আক্রান্ত হয়। পরিস্থিতি উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো হয়।

প্রশাসনিক শৃঙ্খলা : ৫ আগস্টের পর দেশের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। আতঙ্ক, অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা সব প্রতিষ্ঠানে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দ্রুত সরকারের পতন হয়েছে, যেটাকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি কারও ছিল না। ফলে প্রশাসনে এর প্রভাব পড়ে। এছাড়াও পদোন্নতিবঞ্চিতদের ক্ষোভসহ চরম অস্থিরতা নেমে আসে। তবে ইতোমধ্যে অনেক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।

অর্থনীতি : বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে আস্থাহীনতা ছিল অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যানে। অর্থনীতির অবস্থা ফুলিয়ে-ফাপিয়ে দেখানো হলেও বিভিন্ন সূচকের বাস্তব পরিস্থিতি ছিল দুর্বল। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, রপ্তানি আয়-সবকিছুই ছিল মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। এ পরিসংখ্যান নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রশ্ন তৈরি হয়। কিন্তু এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা মেলেনি। এছাড়াও সীমাহীন অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ এবং ঘুস-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে বেপরোয়া লুটপাট হয়েছে। এসব তথ্য প্রচারে গণমাধ্যমে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গণমাধ্যমে এ তথ্য প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করত। তবে ৫ আগস্টের পর অর্থনীতির সঠিক তথ্য বের হয়ে আসছে। যদিও বেশির ভাগ সূচক নেতিবাচক। তবে দু-একটি সূচক ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তলানিতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়তে শুরু করেছে।

পাচারের টাকা ফেরানোর উদ্যোগ : অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা ছিল দেশ থেকে অর্থ পাচার। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি বলেছে, ১৫ বছরে গড়ে প্রতিবছর দেশ থেকে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, শুধু ব্যাংকিং খাত থেকেই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাচার করা টাকা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। দ্বিপাক্ষিকভাবেও অনেক দেশের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।

রাজনীতি : পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় প্রভাব পড়েছে। এর আগে একটি দল ও জোট ছাড়া অন্যদের রাজনৈতিক কর্মসূচি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সরকারবিরোধী বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন ছিল। কিন্তু অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে। তবে আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ-সংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোট এখনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না।

গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যুনাল : বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের সময় গণহত্যা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ গণহত্যার বিচারের বিষয়টি সামনে এসেছে। এর বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অপরাধ তদন্তে প্রসিকিউশনের আবেদনে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাসহ জড়িতদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ১৮ নভেম্বর আদালতের পরবর্তী শুনানি।

বৈদেশিক সম্পর্ক : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, উন্নয়ন সহযোগী এবং দাতা সংস্থাগুলো অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ইউনূস সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও নানা সূত্র বলছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি স্বস্তির জায়গায় নেই।

বন্যা : সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ অন্তত ১৫ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে ৫২ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। এ বন্যা মোকাবিলায় সারা দেশের মানুষ, ছাত্র-জনতা এবং সরকারের উদ্যোগ ছিল নজিরবিহীন। বন্যাপরবর্তী সময়ে এসব জেলায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়াকেও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল।

শিক্ষা খাত : আন্দোলন চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি অচল ছিল শিক্ষা খাত। আলোচ্য সময়ে শিক্ষার্থীর ক্লাস, পরীক্ষা-সবকিছুই বন্ধ ছিল। তবে শিক্ষা খাতে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল, তা কাটাতে কাজ শুরু করেছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল, তা এখন কমে এসেছে।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু : গত তিন মাসে আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবি অন্যতম। একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের হার্ড কপি তিনি পাননি। কিন্তু এর আগে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। দুই সময়ে তার দুই ধরনের বক্তব্যের প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আবারও মাঠে নামেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তবে বিষয়টি রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু অন্যান্য দল তার পদত্যাগ চাইলেও বিএনপি চায়নি। ফলে বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে।

প্রসঙ্গত, ১৫ বছরে চরম দুঃশাসনে রূপ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদ, চরম মিথ্যাচার, একদলীয় শাসন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ সব খাতে লুটপাট হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুথানে রূপ নেয়। ইতিহাসের পাতায় রক্তে লেখা হয় ৫ আগস্ট। ওইদিন রক্তের সাগরে ভেসে যায় ১৫ বছরের স্বৈরাচার। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচার হাসিনা। বিশ্ব দেখে এক নতুন বাংলাদেশ। দেড় হাজার ছাত্র-জনতার জীবন বিসর্জন, অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্ব এবং ৩৫ হাজারের বেশি আহতের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনমুক্ত হয় বাংলাদেশ। ড. ইউনূসের ভাষায় এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম