গুম কমিশনে ১৬শ অভিযোগ
আট বন্দিশালার সন্ধান ঢাকা ও আশপাশে
এখনো খোঁজ মেলেনি ২০০ মানুষের * ৪শ অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি র্যাবের বিরুদ্ধে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গুম কমিশন
গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে ১৬শ অভিযোগ জমা পড়েছে । এর মধ্যে ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে ৪০০টি। এর মধ্যে ১৭২টি অভিযোগ মিলেছে র্যাবের বিরুদ্ধে। অভিযোগ পর্যালোচনা করতে গিয়ে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় আটটি গোপন বন্দিশালার খোঁজ পাওয়া গেছে। এসব বন্দিশালা আয়নাঘরের চেয়েও ভয়ানক দাবি করলেও তদন্তের স্বার্থে এগুলো কাদের তত্ত্বাবধানে চলদ এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক, জঙ্গি সন্দেহসহ চার কারণে অধিকাংশ গুমের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানানো হয়। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে বক্তব্য রাখেন কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, গুমের বন্দিশালা বা আয়নাঘরগুলো পরিদর্শন করার কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে ডিজিএফআই, র্যাব-১ (উত্তরা), র্যাব হেডকোয়ার্টার, র্যাব-১১ (নারায়ণগঞ্জ), র্যাব-২ (বছিলা), র্যাব-২ ক্রাইস প্রিভেনশন সেন্টার (আগারগাঁও) পরিদর্শন করেছি। ডিবিতে আগে পরিদর্শন করা হয়েছে।
কী কী কারণে গুম করা হতো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আবার কিছু ফেসবুকে সমালোচনা করার কারণে হয়েছে। কিছু লোক গুম হয়েছে যাদের কোনো পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি (রাজনৈতিক পরিচয়) ছিল না। কিছু আছে যারা সরকারের সমালোচনা করছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। সেনাবাহিনীর যেসব সদস্যকে গুম করা হয়েছে, তাদের কেন করা হয়েছে সেটা বোঝা যায়নি। কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল অনেকেই আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। কমিশনের সভাপতি আরও বলেন, এই মুহূর্তে কতজন গুম আছে এটা বলা মুশকিল। অনেকগুলো কেসের গুম কী কারণে তা বুঝতে পারছি না। প্রমাণ মিলছে না। ৪০০ কেস পর্যালোচনায় আমাদের আওতায় পড়ে না এমন ২২টি কেস পেয়েছি। পূর্বশত্রুতা কিংবা অন্য কোনো কারণে হয়তো কোনো ভাড়াটিয়া লোকদের দিয়ে গুম করেছিল। সেই কেসগুলো পুলিশদের কাছে পাঠিয়ে দেব, তারা ইনভেস্টিগেশন করবে। কমিশন জানিয়েছে, এসব গুমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্যকে ডাকা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পর্যায়ক্রমে অভিযুক্ত অন্যদেরও ডাকা হবে।
কমিশন অভিযোগ করে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের যেসব গোপন বন্দিশালায় রেখে নির্যাতন করা হতো, সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। আলামত নষ্ট করা হয়েছে। তবে যারা আলামত নষ্ট করছেন, তাদের সতর্ক করেছে কমিশন। যারা আলামত ধ্বংস করছেন, তারা গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সহযোগী হিসাবে বিবেচিত হবেন বলে সতর্ক করা হয়েছে। আলামত ধ্বংস না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে কমিশন।
কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেছেন, আমরা র্যাব পরিচালিত একটি সেল পেয়েছি, যেটির কক্ষগুলো ছিল মাত্র সাড়ে তিন বাই ৪ ফুট। আলো ঢোকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। একটি ড্রেন ছাড়া সেখানে কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ছিল না। এমন পরিবেশেই বন্দিদের বছরের পর বছর সেখানে আটকে রাখা হয়।
৫ আগস্টের পর তিনজন গোপন বন্দিশালা থেকে বের হয়েছেন। এদের বাইরে কী আর কেউ আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, তিনজনের বাইরে আরও দু-একজনের খবর আমরা পেয়েছি। ইতোমধ্যে কথাও বলেছি। এখনই বলা যাবে না যে, ৫ তারিখের পর কতজন রিলিজ হয়েছে। পত্রপত্রিকা ও বিভিন্নভাবে আমরা জানতে পেরেছি দুশত মানুষের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। সেখানে আমরা বলতে পারছি না যে, এটা গুম কী গুম না। তবে অধিকাংশ পরিবার থেকে অভিযোগ করছে যে, সাদা মাইক্রোবাসে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত যতগুলো খবর পত্রপত্রিকা করেছে সবগুলো ঘটনার দালিলিক প্রমাণ পেয়ে গেছি। মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে, কীভাবে দিন গণনা করে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আয়নাঘরের চেয়েও নিকৃষ্টতম সেল কাছাকাছি জায়গাতেই ছিল। আমরা সেগুলো পরিদর্শন করেছি, দেখেছি।
গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আয়নাঘরের মতো যতগুলো জায়গায় আমরা গিয়েছি সেখানে বন্দি অবস্থায় কাউকে পাইনি। অনেকগুলো বন্দিশালা ধ্বংস করা হয়েছে। ভিকটিমের বর্ণনা অনুযায়ী আমরা সেগুলো পেয়েছি। কমিশনের যাচাই-বাছাই করা ৪০০ গুমের অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি ঘটনায় র্যাব, ৩৭টি ঘটনায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), ২৬টি ঘটনায় ডিজিএফআই, ৫৫টি ঘটনায় ডিবি, ২৫টি ঘটনায় পুলিশ ও ৬৮টি ঘটনায় অন্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি অনেক জায়গায় বিভিন্ন বাহিনীর সেফ হাউজ আছে। আমাদের সোর্সের মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করছি অ্যাকজাক্ট লোকেশনগুলো কোথায়।
কমিশনের আরেক সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বন্দিশালার প্রমাণ নষ্ট করছে। তারা সেল ও দেয়াল ভেঙে ফেলছে। যেসব বাহিনী প্রমাণ নষ্ট করছে তারা আমাদের সহযোগিতা করছে না। এখনকার কর্মকর্তারাও আগের কর্মকর্তাদের অপরাধে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক, জঙ্গি সন্দেহে, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কারণেও মানুষ গুম হয়েছে। আমাদের ধারণা ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকায় গোপন বন্দিশালা পাব। ঢাকার বাইরেও প্রতিটি এলাকায় পাওয়া যেতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আলামত ধ্বংস করে নিজেদের রক্ষা চেষ্টা করে লাভ নেই। যে ভিকটিম বেঁচে আছে তাদের জবানবন্দি অলরেডি কালেক্ট করা হয়েছে। সেই জবানবন্দি অনুযায়ী আমরা গোপন বন্দিশালা খুঁজে বের করব। গোপন বন্দিশালা ধ্বংস করার আগে নিজেকে রক্ষা করুন। গত ২৭ আগস্ট গুমসংক্রান্ত কমিশন গঠন করে সরকার। এই কমিশনের কাছে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গুমের ঘটনার অভিযোগ জানানোর সুযোগ ছিল কমিশনে। গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬০০ গুমের অভিযোগ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরে গুমের অভিযোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন-হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।