রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে হলে নির্বাচনে নজর দিন: মির্জা ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে হলে নির্বাচন জরুরি মন্তব্য করে অন্য বিষয়ে নজর না দিয়ে নির্বাচনে জোর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করার লক্ষ্যে গঠিত সার্চ কমিটি দ্রুতই কমিশন গঠন করবে এবং সেই কমিশন দ্রুততার সঙ্গেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। সদ্য পদত্যাগী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তিন মাসে যদি হাবিবুল আউয়ালরা নির্বাচন করে ফেলতে পারেন, তাহলে কেন পারা যাবে না। চাইলেই পারা যাবে, সে চেষ্টা করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই সরকারের অন্য কোনোরকম রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই।’ এই বিশ্বাসের ভিত্তি উল্লেখ করে বলেন, কারণ (অন্তর্বর্তী সরকারের) এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সারা পৃথিবীতে সমাদৃত এবং তিনি কমিট (অঙ্গীকার) করেছেন যে তার কোনোরকমের রাজনৈতিক ইচ্ছা নেই। বুধবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দেশের মানুষ আপনাকে খুবই ভালোবাসে। আপনাকে সম্মান দিয়েছে, দেবে এবং দিতে চায়। একটাই অনুরোধ থাকবে, আপনার এই জায়গা যাতে নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।’
সরকার সময়ের সদ্ব্যবহার করবে বলে আশা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্যান্য বিষয়ের দিকে না গিয়ে নজরটা ওইদিকে দেবেন, ইলেকশন (নির্বাচন)- এটার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে হলে, জাতি হিসাবে টিকে থাকতে হলে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে এখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন করতে হবে। সেই কারণেই কিন্তু এতগুলো প্রাণ গেছে, এত মানুষ দীর্ঘকাল ধরে লড়াই করেছে, সংগ্রাম করেছে, কারাগারে গেছে।’
বর্তমান সময়কে ‘কঠিন’ ও ‘বড়ই জটিল’ আখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো হঠকারিতার কারণে যদি ভুল হয়ে যায়, আমরা রাষ্ট্র হিসাবে বড় বিপদে পড়ে যাব। কারণ আমাদের বিপদগ্রস্ত করার জন্য, অস্তিত্বকে বিপন্ন করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। এই কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক লোক নন-মন্তব্য করে তিনি বলেন, তারা আমাদের সাহায্য করতে এসেছে, নিরপেক্ষ থেকে রাস্তা দেখিয়ে দেবে। রাজনীতিবিদদেরই সমস্যা সমাধান করতে হবে। রাজনীতিবিদ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, হতে পারে না, এই কথাগুলো মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।
সংস্কারে জনগণের অনুমোদন লাগবে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনীতি ও সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না। রাজনীতি-সংগ্রাম চলতে থাকে এবং সংস্কার হচ্ছে, চলবে। ধন্যবাদ জানাতে চাই সংস্কারের জন্য কতগুলো কমিটি করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার দ্রুত সংস্কার কমিশন থেকে রিপোর্ট নিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরবে এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একটা কথা আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, সব সংস্কার জনগণের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে, জনগণকে মেনে নিতে হবে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার কখনো টেকসই হবে না, এটা মাথায় রাখতে হবে।
ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার সফল হয় না মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আইয়ুব খান চেষ্টা করেছেন, এরশাদ চেষ্টা করেছেন, সেটা সম্ভব হয়নি। সুতরাং এমন কিছু করা যাবে না যেটা আমাদের দেশের সঙ্গে, মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।’ রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপিরও ৩১ দফা প্রস্তাব আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ‘রেইনবো নেশন’, মানুষের অধিকারসহ বিভিন্ন কথা বলেছেন। আমরা অত্যন্ত সচেতন যে, পরিবর্তন-সংস্কার যুগোপযোগী না হয় তাহলে রাষ্ট্র সঠিকভাবে কাজ করবে না। এই বিষয়গুলো আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার মামলায় সারা দেশের ৬০ লাখ মানুষকে আসামি করার কথা উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘এখানে এমন লোক খুব আছে, যারা কারাগারে যায়নি, এমন লোক কম আছে, যারা মামলা খায়নি। ফাঁসি থেকে শুরু করে হত্যা, গুম, খুন-সবকিছু এই দেশে আওয়ামী লীগ করেছে। সেখানে রাতারাতি আমরা সব পরিবর্তন করে ফেলতে পারব না। একটা সময় দিতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা আশা করব, অতিদ্রুত এবং তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) অবশ্যই চেষ্টা করছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘তারা যে কিছু করেনি, সেটা তো নয়। ইতোমধ্যে তারা অনেকগুলো কাজ করেছে। সর্বশেষ যেটা করেছে, নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য একটা সার্চ কমিটি করেছে। যদিও আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এই সার্চ কমিটি গঠন করার আগে রাজনৈতিক দলগুলো, অংশীজনদের সঙ্গে একটু পরামর্শ করবে। যা-ই হোক, সেটাকে আমরা বড় ধরনের সমস্যা মনে করছি না। দ্রুত নির্বাচন কমিশন হোক এবং নির্বাচন কমিশন দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, এটা খুব অল্প সময়। এখনো তিন মাস হয়নি। ১৫-১৬ বছরের জঞ্জাল, গণতন্ত্রকে তিলে তিলে হত্যা করা, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’
নেতাকর্মীদের অস্থির না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি, অস্থিরতা। এত অস্থির হয়ে তো লাভ নেই। মুহূর্তের মধ্যে সব মানুষকে ভালো করে দিয়ে তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এখানে এত সুন্দর একটা নির্বাচন দেবে যে আপনারা সবাই খুশি হবেন। আমাদের সময় দিতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার আমরাই তৈরি করেছি। অন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা যারা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, ছাত্রনেতারা সবাই মিলেই এই সরকার গঠন করেছি। আমরা আশা করছি, সরকার একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেননি অতীতে। সেই ভোট দিয়ে তারা নতুন সংসদ তৈরি করবেন। এটা আমাদের প্রত্যাশা এবং এটাই জনগণ চান।’
অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়া উচিত উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, দেখলাম বাংলাদেশ গর্ভনর বলছেন, ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকরা। রাষ্ট্রদ্রোহিতায় তাদের বিচার হওয়া উচিত, বড় শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ এরা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছে।
এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন-জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপির কেএম আবু তাহের, জাগপার খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, গণদলের এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদ একাংশের ফারুক হাসান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি এসএম শাহাদাত, বাংলাদেশ ন্যাপের এমএন শাওন সাদেকী, ডিএলের খোকন চন্দ্র দাস, এনপিপির জহির হাকিম, শরীফ মনির হোসেন প্রমুখ।