Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সন্ত্রাস টেন্ডারবাজিতে বিপুল বিত্ত

ঝালকাঠিতে আমুর ছায়ায় কোটিপতি ডজনখানেক

Icon

আকতার ফারুক শাহিন ও আক্কাস সিকদার, ঝালকাঠি

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঝালকাঠিতে আমুর ছায়ায় কোটিপতি ডজনখানেক

আমির হোসেন আমু।

আওয়ামী শাসনামলের ১৬ বছরে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন ঝালকাঠি-২ (ঝালকাঠি সদর-নলছিটি) নির্বাচনি এলাকার অন্তত ডজনখানেক আওয়ামী লীগ নেতা। দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়ক সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ছায়ায় থেকে অনৈতিক উপায়ে তারা এ সম্পদের মালিক হয়েছেন। নেতার (আমু) ছায়ায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ অবৈধ নানা উপায়ে তারা হয়েছেন কোটিপতি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অবশ্য এদের কেউই আর এলাকায় নেই। তবে তাদের আলিশান ভবন ঠিকই রয়ে গেছে দ্বিতীয় কলকাতা খ্যাত ঝালকাঠিতে।

নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড খুব একটা না থাকা আমু সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসনে হেরে যান জাতীয় পার্টির প্রার্থী মরহুম জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে। নির্বাচনে হারলেও টেকনোক্রেট কোটায় তাকে খাদ্যমন্ত্রী করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০০ সালে এমপি ভুট্টোর রহস্যজনক মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে অনেকটা জোর করে তার স্ত্রী ইলেন ভুট্টোকে হারিয়ে এমপি হন আমু। ২০০১’র নির্বাচনে অবশ্য সেই ইলেন ভুট্টোর কাছেই তিনি আবার হেরে যান। এরপর তার কথিত জয়যাত্রা শুরু হয় ২০০৮’র নির্বাচন থেকে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বর্জন ও একতরফা নির্বাচনে পরপর চারবার এমপি হন তিনি। এর মধ্যে একবার তিনি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় থাকাকালে পুরো ঝালকাঠিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মাঠে নামা তো দূর, নাম মুখে নিলেও হতে হতো হামলা, মারধর আর মামলার শিকার। আমুর এসব কর্মকাণ্ড দেখভাল করতেন ঝালকাঠিরই কিছু নেতা। আমুর শিষ্য হিসাবে তারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো জেলার টেন্ডার, চাঁদাবাজিসহ অবৈধ আয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বিনিময়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের পার্সেন্টেজ পৌঁছে যেত আমুর কাছে। তার নিজস্ব লোক হিসাবে মাঠে থাকা এসব নেতাও পকেটে পুরতেন কোটি টাকা। এভাবে টানা ১৬ বছরের অবৈধ আয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া নেতাদের তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ।

জিএস জাকির : পুরো নাম রেজাউল করিম জাকির। ঝালকাঠি সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদে একবার জিএস নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সবাই তাকে চেনে জিএস জাকির নামে। জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এই জাকির ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ঝালকাঠিতে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। সাধারণ পরিবার থেকে আসা জাকিরের নেতৃত্বেই চলত বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা ভাঙচুর মারধর। আমুকে তিনি সম্বোধন করতেন ‘আব্বা’ বলে। নিয়ন্ত্রণ করতেন ঝালকাঠির বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি। ই-টেন্ডারে কাজ পেলেও মোটা অঙ্কের টাকা না দিয়ে কেউ কাজ করতে পারতেন না। আমুর নাম ব্যবহার করে বহু মানুষের জমি দখল ও ইটভাটা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জাকিরের নেতৃত্বে ছিল বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে ঝালকাঠিতে বিশাল ভবন, বিকনা ও কুনিয়ারী এলাকায় কয়েকশ’ বিঘা জমি, ঢাকায় প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জাকির।

নূরুল আমিন খান সুরুজ : কৃষকের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সুরুজের উত্থান সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর। আমুর গ্রামের বাড়ি শেখেরহাটের সুরুজ ছিলেন নেতার বিশ্বস্ত ক্যাশিয়ার। তাকে শেখেরহাটের ইউপি চেয়ারম্যানও করেছিলেন আমু। আমুর হয়ে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তা বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন সুরুজ। ব্যয়বহুল কাজগুলো করতেন তিনি নিজেই। বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া চাঁদা এবং ঠিকাদারির পার্সেন্টেজের টাকা পৌঁছে দিতেন আমুকে। এসব করে এরই মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন সুরুজ। তার ছেলে লেখাপড়া করে কানাডায়। সেখানে তার বাড়িও রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। ঝালকাঠিতেও তার বিশাল আয়তনের বসত বাড়ি রয়েছে।

কামাল শরীফ : জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামাল শরীফের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা ছিল এলজিইডি অফিসে। আমুর ছায়ায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের শত শত কোটি টাকার কাজ করেছেন তিনি। জেলার প্রায় সব গার্ডার ব্রিজ কামাল শরীফের করা বলে এলজিইডি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এসব কাজ তিনি অনেকটা জোর করেই ছিনিয়ে নিতেন। কামাল শরীফের বাবা খালেক শরীফ ছিলেন একজন লবণ শ্রমিক। সৎপথের চেষ্টাতেই তিনি লবণ মিলের মালিক হয়েছিলেন। তবে বাবার পথে না গিয়ে কামাল বেছে নেন শর্টকাট। নেতার ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে হামলা মারধর কবজি কর্তনসহ হেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই যা তিনি করেনি। বিনিময়ে তিনি বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। নিজের একটি জুতা কোম্পানিও রয়েছে। ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মলসহ দেশের বহু জায়গায় তার শোরুম রয়েছে। অবৈধ আয়ের টাকায় ময়দা মিলের মালিকও হয়েছেন কামাল শরীফ।

হাফিজ আল মাহমুদ : থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহমুদ ছিলেন ২নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর। বরগুনার ছেলে হাফিজের মামাবাড়ি ঝালকাঠি। এখানে থেকেই তিনি ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। ওস্তাদের (আমু) শিষ্য হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সব ঠিকাদারি দপ্তর আর আয় বাণিজ্যের কেন্দে । অনৈতিক পন্থায় কামিয়েছেনও দুই হাতে। ঝালকাঠি শহরে গড়েছেন বিশাল কমিউনিটি সেন্টার। রাজধানী ঢাকার পুলিশ হাউজিংসহ বিভিন্ন লোকেশনে তার জমি ফ্ল্যাট, ঝালকাঠি শহরে ডিসি অফিসের সামনে ৭তলা একটি ভবন দখলের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া একরের পর একর জমি কেনা, দখল, বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

তরুণ কর্মকার : বাবা নিরঞ্জন কর্মকার ছিলেন নাম করা ইংরেজি শিক্ষক। ছেলে তরুণ কর্মকার পরিচিতি পান ‘চুক্তিতে সমস্যা সমাধান’র মাস্টার হিসাবে। যখন তখন যেখানে সেখানে আমুর সঙ্গে কানে মুখে কথা বলার ক্ষমতা থাকা তরুণ ছিলেন যেকোনো সমস্যা সমাধানের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। বলাবাহুল্য সমস্যা সমাধানের বিনিময়ে তিনি মোটা অঙ্কের টাকাও নিতেন। কথিত আছে, সেই টাকার একটি অংশ যেত আমুর পকেটে। বাড়ি দখল বা উচ্ছেদ, বদলি, পদোন্নতি, চাকরি, থানা পুলিশের তদবির, সবই করতেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে থাকা তরুণ। ঝালকাঠি শহরের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় দারুণ অর্থকষ্ট ছিল এই তরুণের। তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা এবং আমুর স্নেহধন্য হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্নেহের তরুণকে হিন্দু কমিউনিটির নেতা বানিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে দেন আমু। বর্তমানে বাড়ি জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক তরুণের কলকাতার সল্টলেকেও বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, দেশে তিনি তেমন কোনো সম্পদ করেনি। তার অধিকাংশ সম্পদ বিদেশে।

মনিরুল ইসলাম তালুকদার : ঝালকাঠির সবাই তাকে চেনেন মনির হুজুর হিসাবে। আছেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে। বাবা লিয়াকত আলী তালুকদার ছিলেন ব্যবসায়ী। ২০০১ সাল থেকে ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত মনির ফুলেফেঁপে ওঠেন আওয়ামী লীগ আমলে। ঠিকাদারিভিত্তিক সব দপ্তরেই ছিল তার একক আধিপত্য। নেপথ্যে আমুর প্রশ্রয় থাকায় সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও তাকে ভয় পেতেন। দক্ষিণের পরিচিত গাবখান সেতুর ইজারা বাগিয়ে নেন বেশ কয়েকবার। টেন্ডারবাজি আর দুর্নীতি সমানতালে করতেন মনির। আমুকে ম্যানেজ করে পরপর দুবার তিনি ঝালকাঠি পৌরসভার মেয়র বানিয়েছেন বাবা লিয়াকত তালুকদারকে। জোর করে ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি হওয়া মনির দুদকের মামলায় জেলও খেটেছেন। স্ত্রী সন্তান কানাডায় থাকা মনিরের সেখানে বাড়ি সম্পত্তি রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, রাজাপুর উপজেলায় ক্লিনিক এবং বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন মনির।

এদের পাশাপাশি আমুর প্রশ্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি টেন্ডার আর চাঁদাবাজি করে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার তালিকায় আরও রয়েছেন বাসন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে চাউল মনির, শেখেরহাটের রফিকুল ইসলাম নবিন, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাঝাভাই, খন্দকার ইয়াদ মোরশেদ প্রিন্স, থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বনি আমিন বাকলাই, শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ছবির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিল ও শারমিন কেকা, জেলা মহিলা লীগের সম্পাদক ইসরাত জাহান সোনালী এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ হাদিসুর রহমান মিলন। এরা প্রত্যেকেই আলিশান বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, অয়েল ট্যাংকারসহ বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন আমুর ১৬ বছরের আমলে। উল্লিখিতদের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইলে ফোন দিলে প্রায় সবারই ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। একমাত্র নূরুল আমিন খান সুরুজের হোয়াটস্অ্যাপ খোলা থাকলেও কল দিলে তিনি ফোন ধরেননি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম