অর্থনৈতিক মন্দায় পৌনে ৩ বছর ধরে একই ধারা
ভোক্তার মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি
দেলোয়ার হুসেন ও হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে টানা দুই বছর ছয় মাস ধরে ভোক্তার মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি মাত্রায় বেড়েছে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও যেতে হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে।
এ সরকারের প্রথম দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও আয়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে বেশি। ফলে দুই বছর আট মাস ধরে মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে খরচের চেয়ে আয় কম হওয়ায় ভোক্তাকে একদিকে ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে খরচ কাটছাঁট করতে হয়েছে। এতে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদন খাতে ভোক্তার খরচ কমেছে। ফলে একদিকে ভোক্তার ভোগ কমেছে। এর প্রভাবে অর্থনীতিতে মন্দা আরও জেঁকে বসেছে। যা এখন নতুন সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল থেকেই অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট হতে থাকে। ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে মন্দার প্রভাব আরও দৃশ্যমান হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক আক্রান্ত হতে থাকে। প্রথমেই দেখা গেছে, ডলার সংকটে বাড়তে থাকে দাম। এর প্রভাবে আসে রিজার্ভে সংকট। কমতে থাকে রিজার্ভ। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির হার। এসব সংকট এখনো অব্যাহত। আরও এক বছর এসব সংকট মোকাবিলা করতে হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ।
অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব তখনই ভোক্তার ওপর প্রকটভাবে পড়তে শুরু করে, যখন ভোক্তার আয়ের চেয়ে খরচ বেড়ে যায় বা ভোক্তার মজুরি বাড়ার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় মূল্যস্ফীতির হার। তখন ভোক্তা যা আয় করে, জীবিকা নির্বাহ করতে খরচ হয় আরও বেশি। ভোক্তা তখন আচমকা হোঁচট খায়। প্রথমে খরচ কমায়।
এতেও সংসার খরচ সামাল দেওয়া না গেলে তখন আগের জমানো সঞ্চয়ে হাত দেয়। আয়ের চেয়ে খরচ বেশি অব্যাহত গতিতে চলতে থাকলে সঞ্চয় শেষ করে ঋণগ্রস্ত হওয়া শুরু করে। মন্দা আরও দীর্ঘায়িত হলে মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মূল্যস্ফীতি ও মজুরির হারে পার্থক্য বাড়ার প্রভাব সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, মজুরি বাড়ার হার নির্ভর করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থার বৃদ্ধির ওপর। সার্বিকভাবে উৎপাদন বাড়লে মজুরিও বাড়ে। ফলে মজুরি বেশি বাড়ানো সম্ভব হয় না।
কিন্তু পণ্যের দাম বাড়লে বা টাকার মান কমলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেশি বাড়লেই মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বাড়ার হারের মধ্যে পার্থক্য বেশি হয়। তখন মূল্যস্ফ্যীতি বেশি থাকে, মজুরি কম থাকে। তখন মূল্যস্ফীতির ভোক্তার আয় খেয়ে ফেলে। ভোক্তার ভোগান্তি বাড়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, অর্থনৈতিক মন্দা চলতে থাকলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। অর্থাৎ মানুষের আয়ের চেয়ে খরচ কম হয়েছে। ফলে মানুষ সঞ্চয় করতে পেরেছে। তবে এর আগে যখনই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে তখন থেকে মজুরি ও মূল্যস্ফীতির হারের এ ব্যবধান ক্রমেই কমতে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মজুরি বাড়ার চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়ে যায়।
ওই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, এর বিপরীতে মজুরি বেড়েছিল ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বেড়ে ছিল দশমিক ১৪ শতাংশ কম। ওই সময় থেকে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছিল, অন্যদিকে মজুরি বাড়ার হার কমছিল। অর্থাৎ দুই দিক থেকেই ক্ষতির মুখে পড়ছিল ভোক্তা। সেই যে শুরু, ইতোমধ্যে দুই বছর আট মাস চলে এখনো মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বাড়ার হার কম।
গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর বিপরীতে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় দুই শতাংশ কম। দীর্ঘ সময় ধরে আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় মানুষ সব ধরনের অর্থনৈতিক আঘাতে জর্জরিত হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক মানদণ্ডেও আঘাত আসতে শুরু করেছে।
আগামীতে আরও বছরখানেক মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার কম থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭ শতাংশে থাকতে পারে। তবে বছরের কোনো সময়ে তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়লেও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষের আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না। ফলে আরও বছরখানেক ভোক্তাকে খরচের চেয়ে কম আয় দিয়ে জীবন-জীবিকার খরচ কাটছাঁট করে চলতে হবে। এতে ভোক্তার ভোগান্তি আরও বাড়বে।
২০২২ সালের মার্চের পর থেকে মূল্যস্ফীতির হার মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়তে থাকে। ওই সময়ে মজুরির হারও বাড়ছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরির হার ছিল কম। শুরুতে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বাড়ার হারের মধ্যকার ব্যবধান কম ছিল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ ব্যবধান ছিল দশমিক ১৪ শতাংশ। একই বছরের আগস্টে এসে এ ব্যবধান আরও বেড়ে ২ দশমিক ৭২ শতাংশে ওঠে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে। এর বিপরীতে আয় বাড়ার হার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
ওই মাসে আমদানি পণ্যের মূল্যের পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রভাবে পরিবহণ ভাড়া বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতির হারও জুলাইয়ের চেয়ে দুই শতাংশ বেড়ে যায়। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে, সামান্য হারে বেড়েছে মজুরি। এতে ব্যবধান কিছুটা কমেছে, কিন্তু ভোক্তার আয়ের চেয়ে খরচ বেশি ছিল। কারণ তখন পণ্যমূল্য অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কমলেও আগে পণ্যের দাম বেড়ে যে পর্যায়ে উঠেছিল, তার থেকে আরও বেড়েছে।
তবে তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে কম বেড়েছিল। ওই বছরের মার্চে আবার মূল্যস্ফীতির হার আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে ওঠে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে মজুরি খুবই সামান্য বেড়ে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে ব্যবধান বেড়ে ২ দশমিক ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। মার্চ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
মজুরি বাড়ার হার ৭ শতাংশের ঘর থেকে বেড়ে ৮ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। ওই সময়ে মূল্যস্ফীতি ও মজুরির হার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকের মতে, মূল্যস্ফীতি ছিল বেশি, মজুরি ছিল কম। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কঠিন বাস্তবতা আড়াল করতে প্রকৃত তথ্য গোপন করেছিল।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারিত হয় নতুন সরকারের সময়ে। এতে দেখা যায়, এ হার বেড়ে কারসাজি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। যা বাংলাদেশের ১২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। ওই মাসে মজুরি সামান্য দশমিক ০২ শতাংশ কমে ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়ায়। গত আড়াই বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম মজুরির হার সামান্য কমল। এর আগে কখনোই কমেনি।
শুধু বেড়েই চলেছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ও মজুরির ব্যবধান বেড়ে ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশে ওঠে। এরপর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। মজুরির হার সামান্য বেড়েছে। ফলে ভোক্তার আয়-ব্যয়ের ব্যবধানও কিছুটা কমেছে। কিন্তু ভোক্তার মধ্যে স্বস্তির দেখা নেই। কারণ বাজার এখন বড় চড়া। অনেক পণ্যের দামই ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এতে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।