Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনে পুলিশের গুলি

তারা কখনোই আর হাঁটতে পারবে না

মেরুরজ্জুতে বুলেটবিদ্ধ ৮৫ জন কাতরাচ্ছেন সিআরপিতে * পঙ্গুত্বের ঝুঁকিতে থাকা অনেকের শেষ ভরসা হুইলচেয়ার * চিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে : নির্বাহী পরিচালক, সিআরপি

ইকবাল হাসান ফরিদ

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তারা কখনোই আর হাঁটতে পারবে না

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের সরাসরি গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ৮৫ জন কাতরাচ্ছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। এর মধ্যে ৭০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন সাভার সিআরপিতে, বাকি ১৫ জন মিরপুরসহ সিআরপির বিভিন্ন ব্রাঞ্চে। আহতদের বেশির ভাগই মেরুরজ্জুতে পুলিশের গুলি ও বুলেটের আঘাতপ্রাপ্ত। গুলিতে কারও কারও হাত-পা এমনকি পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। আহতদের মধ্যে অনেকের পঙ্গুত্বের ঝুঁকি রয়েছে সারা জীবনের জন্য। সাভার সিআরপিতে চিকিৎসাধীন কয়েকজনের ভবিষ্যৎ ভরসা হুইলচেয়ার। চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করার চেষ্টা চলছে বলে জানায় সিআরপি কর্তৃপক্ষ।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার রসকরদি গ্রামের মাসুদ মিয়া (৩১)। রিকশা চালিয়ে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে হাল ধরেছিলেন ৫ সদস্যের সংসারের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে বিজয়োল্লাস। জীবিকার তাগিদে সেদিন মাসুদ মিয়া রিকশা নিয়ে বের হন। হঠাৎ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় রিকশাচালক মাসুদ মিয়ার মেরুদণ্ডে পুলিশের গুলি এসে ঢোকে। মাসুদকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে (২২ আগস্ট) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে নেওয়া হয়। 

সিএমএইচ থেকে ৬ অক্টোবর নেওয়া হয় সাভারে পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র-সিআরপিতে। এখন সেখানে মাসুদ চিকিৎসা নিচ্ছেন। পাশে রয়েছেন স্ত্রী সানিয়া বেগম। মঙ্গলবার বিকালে তিনি যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাসুদকে সারিয়ে তুলতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তিনি বলেন, ৫ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন মাসুদ। কিন্তু স্বামী আগের মতো সংসারের হাল ধরতে পারবেন কি না, বলতে গিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেন তিনি।

সিআরপির একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় মাসুদের সব জটিলতা সারিয়ে তোলা সম্ভব হলেও তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে হুইলচেয়ারে। 

বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মাসুম আহমেদ (১৪)। সুইডেন প্রবাসী বাবার দুই সন্তানের মধ্যে মাসুম ছোট। বনশ্রীতে পরিবারের সঙ্গে থাকত মাসুম। ১৯ জুলাই বন্ধুদের সঙ্গে বনশ্রী এ-ব্লক মেইন রোডে অবস্থান নেয় সে। ওইদিন দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। 

এ সময় পুলিশের গুলি এসে মাসুমের পেটের ডানদিকে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় ফরাজী হাসপাতাল, পরে মুগদা মেডিকেল নেওয়া হয়। সেখানে তাকে রাখা হয়নি। দেওয়া হয়নি চিকিৎসা। পরে কল্যাণপুর ইবনেসিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সিএমএইচ হাসপাতালে। পরে ২৮ সেপ্টেম্বর সাভারের সিআরপিতে আনা হয়। 

মাসুম যুগান্তরকে জানায়, তার শরীরে নার্ভ ডেমেজ হয়ে গেছে। পেটের নিচ থেকে দুই পা অবশ হয়ে গেছে। প্রস্রাব-পায়খানার বেগ অনুভূত হয় না। পুলিশের গুলির সেদিনের নিষ্ঠুর ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে মাসুম। এ ছোট জীবন কীভাবে সে এ ভয়ানক ক্ষত নিয়ে টেনে নেবে-বলতে গিয়ে শুধু চোখের পানি ফেলে। পরে বলে, দেশের মানুষ তাও ভালো থাকুক। আমি তো আমার জীবনটা বরবাদ করে দিলাম দেশের জন্য।

মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র তাহসিন হোসেন নাহিয়ান (১৫)। মোহাম্মদী হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডে বাসা। তাহসিন জানায়, আন্দোলনে প্রতিদিনই যোগ দিত সে। ৪ আগস্ট অন্য ছাত্রদের সঙ্গে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল সেও। ওইদিন বিকাল ৩টার দিকে খবর আসে জিগাতলার দিক থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এগিয়ে আসছেন। চোখের পলকে তারা চলে আসেন। 

এ সময় ছাত্রলীগ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। একটি গুলি তাহসিনের পিঠে বিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিবিৎসা শেষে তাকে ২১ সেপ্টেম্বর সাভারের সিআরপিতে ভর্তি করা হয়। হুইলচেয়ারে বসিয়ে তাকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। সে যুগান্তরকে বলে, আমার নাভির নিচ থেকে দুই পা অবশ হয়ে গেছে। দোয়া চেয়ে বলে, পুরোপুরি সুস্থ হতে পারব কি না, জানি না। 

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের আশরাফুল যাত্রাবাড়ী থেকে টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন। বাবা জহিরুল ইসলাম আর তার আয়ে চলত ৭ সদস্যের পরিবার। আশরাফুল বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি ৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন। এ সময় পুলিশের গুলি তার ডান কাঁধে সামনের দিক দিয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এখন বুক থেকে নিচের দিকে সারা শরীর অবশ হয়ে আছে আশরাফুলের। 

তিনি যুগান্তরকে বলেন, গ্রেফতারের ভয়ে যাত্রাবাড়ীর একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে সিআরপিতে ভর্তি করা হয়। তিনি জানান, এখানে খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি কর্তৃপক্ষ দিলেও নিজে অসুস্থ, এ দুরবস্থায় পরিবারের সদস্যরা অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বরিশালের হাসান সরদার (২১) চার বছর ধরে ঢাকার বাড্ডায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। 

৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে বাড্ডার সড়কে আহত হন তিনি। তার শরীরে ৩ শতাধিক ছররা গুলি রয়েছে। হাসান সরদার যুগান্তরকে জানান, ডান হাত ও বুক পুরোপুরি অবশ হয়ে আছে। সিআরপির পুনর্বাসন উইংয়ের ডিজিএম সেলিম রহমান যুগান্তরকে জানান, সাভার সিআরপিতে ৭০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ছাত্র। এখানে চিকিৎসাধীন ৭ জন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবেন। যার মধ্যে ৫ জন ছাত্র এবং দুইজন শ্রমজীবী। তারা আর কখনোই হাঁটতে পারবে না। 

তিনি জানান, সিআরপির মিরপুর ব্রাঞ্চে ১২ জন, ময়মনসিংহে ১ জন, সিলেটে ১ জন এবং বরিশালে ১ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিআরপির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ডা. মেহাম্মদ সোহরাব হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা শারীরিক ও মানসিক-দুভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শারীরিকভাবে অনেকেই বিকলাঙ্গ হয়েছেন। যত সময় লাগে লাগুক, তাদের চিকিৎসা দিয়ে যাব। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম