ইসরাইলের হামলায় হামাস প্রধান সিনওয়ার নিহত
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফিলিস্তিনের দক্ষিণ গাজায় ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। বুধবারের এ অভিযানে অংশ নেওয়া সেনারা প্রাথমিকভাবে জানত না ইসরাইলের ১ নম্বর শত্রুকে তারা পেয়ে গেছে। নিহত হওয়ার পর ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ইয়াহিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় বলে ইসরাইলি কর্মকর্তারা জানিয়েছে। ইয়াহিয়ার মৃত্যু হলেও গাজা অভিযান অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এদিকে শুক্রবার হামাসের পক্ষ থেকে ইয়াহিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন গাজার হামাস প্রধান খলিল হায়া। টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ইয়াহিয়া আমাদের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। খবর রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, আল-জাজিরার।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার এক ঘোষণায় বলা হয়, বুধবার দক্ষিণ গাজায় অভিযান চালিয়ে ইয়াহিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। আঙুলের ছাপসহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে বন্দুক যুদ্ধে ইয়াহিয়া নিহত হয়েছেন।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, এক বছর ধরে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও নিরাপত্তা সংস্থা (আইএসএ) গাজায় অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে। এমনকি যে এলাকায় ইয়াহিয়াকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানেও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানের ফলে ইয়াহিয়ার কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছিল। ইসরাইলি বাহিনী তাকে তাড়া করে ফিরছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে নির্মূল করা হলো।
ইসরাইলের কর্মকর্তারা বলেছেন, বুধবার দক্ষিণ গাজার তেল আল সুলতান এলাকায় তল্লাশি-অনুসন্ধান চালানোর সময় ইয়াহিয়াকে পেয়ে যান ইসরাইলের পদাতিক বাহিনী। হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের অবস্থান লক্ষ্য করেই অভিযান চালাচ্ছিলেন ইসরাইলি সেনারা। সেখানে ইয়াহিয়ার থাকার বিষয়টি তারা জানতেন না।
কর্মকর্তারা জানান, অভিযানকালে সেনারা তিনজন সন্দেহভাজনকে বিভিন্ন ভবনের মধ্য দিয়ে সরে যেতে দেখেন। একপর্যায়ে তারা গুলি চালান। দুপক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ সময় ইয়াহিয়া সরে গিয়ে একটি বিধ্বস্ত ভবনে ঢুকে পড়েন। ইসরাইলের গণমাধ্যমের তথ্যে জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে ওই ভবন লক্ষ্য করে ট্যাংক দিয়ে একাধিক গোলা ছোড়ে ইসরাইলি বাহিনী। এ ছাড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া হয়। এরপর ইসরাইলি সেনারা সেই ভবনে গিয়ে সিনওয়ারের মতো দেখতে একজনের লাশ খুঁজে পায়। তখন পরিচয় শনাক্ত করতে প্রথমে লাশ থেকে একটি আঙুল কেটে ইসরাইলে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায় লাশটি সিনওয়ারেরই।
হিব্রু সংবাদমাধ্যম ওয়াল্লা শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পরীক্ষা শেষে সিনওয়ারের লাশ গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেলেছে ইসরাইল। এখন সেটি গোপন স্থানেই রয়েছে। এর আগে আবু কবির ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে সিনওয়ারের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মাথায় গুলি লেগে এবং গোলার আঘাতে সিনওয়ার নিহত হয়েছেন।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, অভিযানকালে ইয়াহিয়াকে শুধু একজন হামাস যোদ্ধা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন সেনারা। তার সঙ্গে ছিল একটি অস্ত্র, একটি প্রতিরক্ষামূলক জ্যাকেট ও ৪০ হাজার ইসরাইলি মুদ্রা শেকেল। হাগারি বলেন, ইয়াহিয়া পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইসরাইলি বাহিনী তাকে নির্মূল করেছে।
সিনওয়ারকে হত্যার বিষয়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে ঘোষণা আসার পর হামাসের ঘনিষ্ঠ মিত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন এক অধ্যায় শুরু করছে। আর ইরান বলেছে, সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ডে এই অঞ্চলে প্রতিরোধ আরও জোরালো হবে।
এদিকে হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যার তথ্য নিশ্চিত করেছেন গাজার হামাস প্রধান খলিল হায়া। এক টেলিভিশন ভাষণে শুক্রবার তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতার জন্য সিনওয়ার তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাকে ‘অটল, সাহসী এবং নির্ভীক’ উল্লেখ করে, খলিল হায়া বলেন, ‘তিনি সাহসিকতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। মাথা উঁচু করে তিনি, আগ্নেয়াস্ত্র ধরে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত গুলি চালিয়ে গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, গাজায় হামলা বন্ধ এবং সেখান থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত জিম্মি থাকা ইসরাইলিদের ফেরত দেওয়া হবে না।
এদিকে বৃহস্পতিবার হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরাইলি শত্রুপক্ষের সঙ্গে চলমান সংঘাত একটি নতুন এবং ক্রমবর্ধমান অধ্যায়ে রূপান্তরিত হয়েছে বলে ঘোষণা দিচ্ছে হিজবুল্লাহ।’ আগামী দিনগুলোতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এ ঘোষণার প্রতিফলন দেখা যাবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে হিজবুল্লাহ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে চালানো হামলার হামলার প্রধান কারিগর বলে মনে করা হয় ইয়াহিয়াকে। ইসরাইল সরকারের তথ্য অনুসারে, হামাসের এই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ ছাড়া প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। জবাবে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরাইল। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪২ হাজার ৪৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
জুলাই মাসে ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর হামাসের সামগ্রিক নেতা হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইসরাইলি কর্মকর্তাদের চোখে ইয়াহিয়া ছিলেন একজন ‘নির্মম’ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রু।
হামাসকে নির্মূলের অঙ্গীকার : গাজা যুদ্ধের শুরুতে হামাসকে নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে প্রচারিত ভিডিও বিবৃতিতে তিনি বলেন, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। যদিও এটি গাজা যুদ্ধের শেষ নয়, এটি শেষের শুরু।
পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া : হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পশ্চিমা কয়েকটি দেশ। তারা এ ঘটনাকে ইসরাইলের জন্য বড় সাফল্য বলে বিবেচনা করছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা জোরদার করবে বলেও তারা প্রত্যাশা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের জন্য আজ একটি শুভদিন। ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ায় গাজার বুকে হামাসের ক্ষমতার অবসান ঘটবে। একটি রাজনৈতিক মীমাংসার সুযোগ তৈরি হবে। এতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিরা একটি ভালো ভবিষ্যৎ উপহার পাবে।
হোয়াইট হাউজ বলেছে, সিনওয়ারকে খুনের মিশনে সফল হওয়ায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাইডেন।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে এক নির্বাচনি সমাবেশে কমলা হ্যারিস বলেন, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলায় যারা ভুক্তভোগী এবং গাজায় যেসব জিম্মিকে হত্যা করা হয়েছে তারাসহ হাজারও নিষ্পাপ মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী সিনওয়ার। তার মৃত্যু অবশেষে গাজায় যুদ্ধ শেষ করার সুযোগ করে দিল।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ইহুদিদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দিনের জন্য দায়ী ইয়াহিয়া সিনওয়ার। যুক্তরাজ্য তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবে না। তিনি আরও বলেন, জিম্মিদের মুক্তি, যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি লম্বা সময় ধরে বিলম্বিত হচ্ছে। এখন আমরা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এ ঘটনাকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর জন্য বড় সাফল্য বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য এ সুযোগকে কাজে লাগানো উচিত। এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সামরিক অভিযান বন্ধ করা জরুরি বলেও তিনি মনে করছেন।
সিনওয়ারের হত্যায় প্রতিরোধ জোরালো হবে : এদিকে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ডে ওই অঞ্চলে প্রতিরোধ আরও জোরালো হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি দল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে ইরানের প্রতিনিধি দল বলেছে, ‘প্রতিরোধ শক্তিশালী হবে। তিনি (সিনওয়ার) যুবক ও শিশুদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন, যারা তার দেখানো পথ ধরে ফিলিস্তিনকে মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে। যত দিন দখল ও আগ্রাসন চলবে, ততদিন প্রতিরোধও জারি থাকবে। শহিদরা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থাকবেন।’