আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগ
হাসিনার বিরুদ্ধে পরোয়ানা
১৮ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশ: গ্রেফতারি পরোয়ানার তালিকায় আরও আছেন-সজীব ওয়াজেদ জয়, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জন * তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে-চিফ প্রসিকিউটর
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া পৃথক অভিযোগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলার পরবর্তী তারিখ ১৮ নভেম্বর ধার্য করে এই সময়ে আসামিদের আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রসিকিউশনের করা পৃথক আবেদন গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। অন্য সদস্যরা হলেন-বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। প্রসিকিউশন জানায়, গোপনীয়তার কারণে আসামিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়।
এছাড়া সারা দেশে প্রায় দুই শতাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার পর এই প্রথম কোনো আদালত থেকে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। এখন তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের পর ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবে প্রসিকিউশন।
আদেশের পর চিফ প্রসিকউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আদালতে বলেছি, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামি প্রভাবশালী। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা প্রয়োজন। পরে শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন।
এর আগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার তারিখ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এ সময়ে আহত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তারিখে নিহতরাও এর আওতায় থাকবে। ঘটনার স্থান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে। অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামি দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে।
১৫ অক্টোবর নিয়োগের পর বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় কর্মদিবসে সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী এদিন ট্রাইব্যুনালে আসেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও অন্য কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান।
অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনান। এ সময় সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গুম, খুন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, শাপলা চত্বরে হত্যা, আয়নাঘর, কানাডার বেগমপাড়াসহ অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বলপ্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে বলেন, ১৪ দলের নেতারা বৈঠক করে গণহত্যায় সমর্থন ও উসকানি দিয়েছেন। গণহত্যার সময় কিছু ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গণহত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।
চিফ প্রসিকউটর আদালতে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ পর্যায়ে আদালত জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কিনা। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, না। তারপর আদালত চিফ প্রসিকিউটরের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আর ১৮ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে বলেন। পরে সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শুনান চিফ প্রসিকিউটর। শুনানি শেষে একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
পরে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করে এই আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
আসামিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ না করার কারণ জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আপনারা জানেন এটা একটি বিশেষ কোর্ট। আসামিদের তালিকা যদি আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশ করি তাহলে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে, তারা তো পালিয়ে যাবেন। আমরা আদালতের কাছে আবেদন করেছি, এটি গোপন রাখার জন্য। তিনি বলেন, আপনারা জানেন আইনে ক্যামেরা ট্রায়ালের ব্যবস্থা রয়েছে। যদি কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রকাশ্যে গ্রহণ করা না যায়, তাহলে সেটা ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে গোপন রাখা যেতে পারে।
কোন প্রক্রিয়ায় ফেরানো হবে শেখ হাসিনা ও বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামিদের, এমন প্রশ্নে তাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এবং আন্তর্জাতিক আইনে যেসব ব্যবস্থা আছে সেই সব প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করেই এ গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করা যাবে। তিনি জানান, নিরাপত্তার কারণে ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশে বিধিনিষেধের সিদ্ধান্ত সাময়িক।
আরও যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা : ট্রাইব্যুনাল আরও যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সাবেক মন্ত্রী শেখ সেলিম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও জুনায়েদ আহমেদ পলক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও তার ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার ও প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। বাকিদের নাম তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশন টিম।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা অভিযোগ প্রাথমিক তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে বিচারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ও সংবিধানের ৪৯ ধারা প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারামতে সংবাদপত্রের তথ্য ও কারও মৌখিক সাক্ষী দ্বারা বিচার করা যাবে আসামিদের।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচারকাজ। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের কিছুদিন পরেই ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান। আর এক সদস্যকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
অপর সদস্য অব্যাহতি নেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটররা পদত্যাগ করেন। পরে ৫ সেপ্টেম্বর চিফ প্রসিকিউটরসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ।
এদিকে ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল। ১৬ অক্টোবর তাদের এজলাসে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।