দায় চাপানোর পালটাপালটি চেষ্টা
রাষ্ট্রীয় সহায়তায় নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভোটার তালিকার তথ্যভান্ডার থেকে তথ্য টাকার বিনিময়ে বিক্রির দায় এককভাবে নিতে রাজি নয় কোনো প্রতিষ্ঠান। নাগরিকের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে তথ্য বিক্রির সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিজিপি)’ এবং ‘অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ)’-এর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই বিষয়টি সামনে এনে একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি), বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ও তথ্য বিক্রিকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিস লিমিটেড। চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ এনে সম্প্রতি বিসিসিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ইসি। আবার বিসিসি নোটিশ দিয়েছে ডিজিকনকে। ওই নোটিশের জবাবে ডিজিকন সরকার ও ইসির অনুমোদন রয়েছে বলে তথ্য জানিয়েছে। তবে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে এসব প্রক্রিয়ার অনেক বিষয় গোপন করার চেষ্টাও করছেন বেশ কয়েক কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য বিক্রির মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ উঠলেও তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত সংযোগ (অ্যাপলিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস-এপিআই) এখনই বন্ধ করছে না ইসি। ওই সংযোগ বন্ধ করে দিলে পরিচয় প্ল্যাটফরম থেকে সেবা নেওয়া ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করছেন ইসি ও বিসিসির কর্মকর্তারা।
ইসি ও বিসিসির সূত্র জানিয়েছে, পরিচয় প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে ডিজিকন কমবেশি চারশ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসছে। চুক্তি অনুযায়ী বিসিসির সঙ্গে যৌথভাবে এসক্রো অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনের কথা থাকলেও তা মানেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত কত টাকা আয় করেছে, এর নিয়মিত কোনো হিসাবও দেয়নি। এছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে ওই প্রতিষ্ঠানটি সার্ভার তৈরি করেছে বলে জানতে পেরেছে বিসিসি।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান শরীফ কোনো উত্তর দেননি। এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে দেওয়া মেসেজের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিষয়টি তদন্ত করছে। ওই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন।
বিদেশে সার্ভার থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকদের তথ্য সংরক্ষণ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে সার্ভার রয়েছে ডিজিকনের। যেহেতু তারা সার্ভার স্টেশন বসিয়েছে, সেহেতু সেখানে তথ্য সংরক্ষণ করেছে-এটা ধরেই নিতে হবে। দেশের বাইরে ডেটা রাখার কোনো অনুমোদন নেই। এটি চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে কমিটি। ওই কমিটির প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারে ১৩ কোটি ১১ লাখ ৪১ হাজার ৫১৯ জন বাংলাদেশি নাগরিকের ৪৬ ধরনের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে এখনো ভোটার হওয়ার ১৮ বছর বয়স হয়নি-এমন নাগরিকও রয়েছেন। আইন অনুযায়ী, নাগরিকের গোপনীয় তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর দণ্ডনীয় অপরাধ।
ভোটার তালিকার তথ্যভান্ডারে থাকা নাগরিকদের গোপনীয় তথ্য দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির বিষয়ে ৪ সেপ্টেম্বর ‘রাষ্ট্রীয় সহায়তায় নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় যুগান্তরে। পরবর্তী সময়ে ‘জয়’-এর তথ্য বিক্রির ফরমুলা’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যমুনা টেলিভিশন। এ দুটি সংবাদকে উদ্ধৃত করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকসহ ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে কাফরুল থানায় মামলা করেন এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি। এতে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ‘আত্মসাৎ’ করার অভিযোগ করা হয়। ওই মামলায় ডেটা সেন্টারের সাবেক পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মামলায় ইসির বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে চারজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা কেএম নুরুল হুদা কমিশন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সাবেক মহাপরিচালক তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম ও একেএম হুমায়ুন কবীর, তৎকালীন ইসি সচিবসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়নি।
একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাগরিকের তথ্য বিক্রির ঘটনায় নির্বাচন কমিশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং ডিজিকন একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি চিঠি চালাচালি, শোকজ এবং এর উত্তরে এ প্রবণতা দেখা গেছে। কম্পিউটার কাউন্সিল শর্ত লঙ্ঘন করে পরিচয় প্ল্যাটফরমকে তথ্য সরবরাহ করেছে বলে বিসিসিকে চিঠি দিয়েছে ইসি। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় পক্ষ হিসাবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে তথ্যভান্ডারের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কমিশনের তথ্য-উপাত্ত কোনো অবস্থায় অন্য কোনো ব্যক্তি, স্বত্বা, পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর, বিনিময়, বিক্রয় বা অন্য কোনো পন্থায় দেওয়া যাবে না। নির্বাচন কমিশন থেকে তথ্য নিয়ে পরিচয় প্ল্যাটফরমকে তা সরবরাহ করে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। ওই চিঠিতে কয়েকটি বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করা এবং ওই সংযোগ কেন বন্ধ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
ইসির ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিসিসি মাস্টার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট ভঙ্গের অভিযোগ এনে ডিজিকন কর্তৃপক্ষকে শোকজ করে। চুক্তির ৩ ও ৪ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে জানিয়ে শোকজ নোটিশে বলা হয়, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়াই ডিজিকন শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে তথ্যসেবা দিয়ে আসছে। বিদেশি বা আন্তর্জাতিক সংস্থাকে তথ্য সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ডিজিকন তা লঙ্ঘন করে ব্রিটিশ কাউন্সিলকে তথ্য দিয়েছে। এছাড়া এসক্রো অ্যাকাউন্ট ছাড়াই লেনদেন করেছে ডিজিকন। এ পর্যন্ত কত টাকা আয় করেছে, এর হিসাব দেয়নি। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিজিপি)’, ‘অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ)’ এবং নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ডিজিকন তথ্যসেবা দিয়ে আসছে বলে জবাব দেয়।
৯ অক্টোবর বিসিসি তার অবস্থান জানিয়ে ইসির চিঠির জবাব দিয়েছে। ওই চিঠিতে পরিচয় চালুর ক্ষেত্রে ইসির সমর্থন থাকার কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আইসিটি বিভাগের নির্দেশনা ও বিএনডিএ নির্দেশিকার ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ডিজিকন পরিচয় প্ল্যাটফরম চালু করে। এতে তৎকালীন সরকারের অনুমোদন রয়েছে। পরিচয় প্ল্যাটফরম চালুর ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব সভায় নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন, তারাও এর পক্ষে ইতিবাচক মতামত দেন। তবে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, তৃতীয় পক্ষের কাছে তথ্য সরবরাহের বিষয়টি বিসিসির কাছে স্পষ্ট নয়। তবে ডিজিকন আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নেবে বিসিসি। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তিন পক্ষের চিঠিতে একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম যুগান্তরকে বলেন, কম্পিউটার কাউন্সিলের জবাব মঙ্গলবার পেয়েছি। ওই চিঠিতে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এছাড়া এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় তদন্তে যে বা যারা দায়ী হবেন, তাদের সেই দায়ভার বহন করতে হবে। মামলা হওয়ায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নিজ থেকে কোনো তদন্ত করছে না।
যদিও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া মনে করেন, ডিজিকন চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে আসছে। তিনি বলেন, ডিজিকন বিসিসির একধরনের অপারেটর। তারা পিপিপিতে অংশীদার নয়। কিছু কিছু বিষয়ে তারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। যেমন যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলেনি। নিয়মিত আয়ের স্টেটমেন্ট দেয়নি। অডিট করার কথা ছিল, তারা তা করতে আমন্ত্রণ জানায়নি। তিনি আরও বলেন, এখন আমরা সবকিছুই খতিয়ে দেখছি। প্রয়োজনে তাদের যন্ত্রাংশের ফরেনসিক করা হবে। তাহলে পুরো ঘটনা জানা যাবে।