নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত
উচ্চ খেলাপির ঝুঁকি কাটছে না দুর্গতি
খুবই নাজুক ৯, নাজুক ৯, নাজুকের পথে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে বর্তমানে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। এর মধ্যে খুবই নাজুক ৯টি, নাজুক ৯টি এবং নাজুকের পথে আরও ১০টি মিলে ২৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। কিছুটা ভালো এবং খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে মাত্র ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, এস আলমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। দীর্ঘদিন আমানত ফেরত দিতে পারছে না। ফলে পুরো খাতে ছড়িয়ে পড়েছে অনাস্থা। এরপর শুরু হয় তীব্র তারল্য সংকট। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া কোনো ভিন্নতা বা নতুনত্ব নেই। যেখানে ব্যাংক ঋণ দেয়, সেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ঋণ দেয়।
ফলে ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে নানা অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণেও অনেকে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে।
জানতে চাইলে এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতে যেভাবে সংস্কার চলছে। সেভাবে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও সংস্কার করা যেতে পারে। এছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রশান্ত কুমার হালদার বা পিকে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার পর মুখ থুবড়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এসব প্রতিষ্ঠান। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভবানা দেখছেন না আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের ৮৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। পিকে হালদারসহ একটি চক্র প্রতিষ্ঠানটির সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠাটির ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি। ঋণ বিতরণ করা হয় ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি ৫৫০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট আলোচিত প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের ঋণখেলাপি ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। তবে জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি নেই।
তৃতীয় অবস্থানে পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির ৮৯১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ-ই এখন খেলাপি। তবে প্রভিশন ঘাটতি না থাকলেও খেলাপিসহ অন্যান্য কারণে ১৩১ কোটি টাকার লভ্যাংশ নিজস্ব হিসাবে যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পিকে হালদারের ৩ প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটি ছাড়াও ফারইস্টের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি ব্রোকারেজ হাউজ ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এমএ খালেক, যিনি এক সময় ফারইস্ট ফাইন্যান্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্রোকারেজ হাউজটির কাছে আটকে আছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এরপর ওয়েস্টার্ন মেরিনে ১৭ কোটি, সানম্যান গ্রুপে ১৫ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্স গ্রুপে ১৪ কোটি ও ইমাম গ্রুপে ১৩ কোটি টাকা আটকে আছে।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি) বর্তমানে খেলাপির দিক দিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল ৭৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতিও রয়েছে আড়াই কোটি টাকার বেশি।
তালিকায় ৫ম স্থানে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং লুটে নেতৃত্ব দিয়েছেন আলোচিত পিকে হালদার। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২৫০০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন পথে বসেছে। আলোচিত পিকে হালদারের নেতৃত্বে টাকাগুলো লুট করা হয়। এর মূল চাবিকাঠি নাড়েন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের তখনকার ডিএমডি রাশেদুল হক; যিনি পরে প্রতিষ্ঠানটির এমডিও হন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত ছিল এই চক্র। মূলত এই প্রতিষ্ঠানের ঋণের সিংহভাগেরই সুবিধাভোগী পিকে হালদার ও চট্টগ্রামভিত্তিক আলোচিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম।
শেয়ারবাজারে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল আছে তালিকার ষষ্ঠ স্থানে। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ঋণের অঙ্ক ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
নেতৃত্বের দুর্বলতায় ডুবতে বসা ফার্স্ট ফাইন্যান্সের স্থান ৭ম। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ঋণ বিতরণ করে ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৭০৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮৮ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৮৩ কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আভিভা ফাইন্যান্স আছে তালিকার অস্টম স্থানে। প্রতিষ্ঠানটির আগের নাম ছিল রিলায়েন্স ফাইন্যান্স। পিকে হালদারের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান লুট করেছে। তার মধ্যে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ছিল অন্যতম। পরে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে আভিভা ফাইন্যান্স রাখা হয়। কিন্তু চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক ২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকায় খেলাপি, যা বিতরণ করা ঋণের ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৪৪১ কোটি টাকা। এরই মধ্যে আভিভা ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। ঋণ অনিয়মসহ নানা কারণে ডুবতে বসা ফিনিক্স ফাইন্যান্স আছে তালিকার নবম স্থানে। অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গত বছরের ডিসেম্বরে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এসএ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, আমান সিমেন্ট মিলস ইউনিট-২, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ঋণ দিয়েছে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি বর্তমানে ১৪ কোটি টাকা।
এছাড়া নাজুক অবস্থায় রয়েছে আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান। যেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সিভিসি ফাইন্যান্সের ৭২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রাইম ফাইন্যান্সের ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া আইআইডিএফসির ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৫৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ, উত্তরা ফাইন্যান্সের ৫৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৫৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং হজ ফাইন্যান্সের ৫১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এছাড়া নাজুক হওয়ার পথে ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ খেলাপি থাকা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫টি এবং ১০ থেকে ২০ শতাংশ খেলাপি থাকা প্রতিষ্ঠান ৫টি। এছাড়া ৭টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ১০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪টি।